আমি হাতলের উপর হাত রাখতেই নাইলনের দড়ি দিয়ে সায়রা হাতগুলো বেঁধে ফেলল। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, হাত বাঁধছেন কেন?
ব্রেনের মাঝে স্টিমুলেশন দিচ্ছি– কী হয় কে বলতে পারে? হয়তো হাত-পা ছুঁড়ে আপনার শরীরে খিঁচুনি শুরু হয়ে যাবে। রিস্ক নিয়ে লাভ আছে?
আমি আর কোনো কথা বলার সাহস পেলাম না। চুপচাপ চেয়ারে বসে রইলাম। বুক ঢাকের মতো শব্দ করে ধকধক করতে লাগল, গলা শুকিয়ে কাঠ। সায়রা কাছে এসে আমার মাথায় হেলমেটটি পরিয়ে দিয়ে স্টাপ দিয়ে সেটা থুতনির সাথে বেঁধে দিয়ে তার যন্ত্রপাতির সামনে চলে গেল। নানারকম সুইচ টেপাটিপি করে বলল, জাফর ইকবাল সাহেব, আপনি চেয়ারে মাথা রেখে রিলাক্স করেন।
আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, করছি।
স্টিমুলেশন দেওয়ার পর আমি আপনাকে প্রশ্ন করব। আপনি তখন সেই প্রশ্নের উত্তর দেবেন। ঠিক আছে?
আমি আবার চিঁ চিঁ করে বললাম, ঠিক আছে।
সায়রা একটা হ্যান্ডেল টেনে বলল, এই যে আমি স্টিমুলেশন দিতে শুরু করেছি। দশ ডিবি পাওয়ার, কিছু টের পাচ্ছেন?
আমি ভেবেছিলাম মাথার ভেতরে সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটতে শুরু করবে কিন্তু কিছুই ঘটল না। বললাম, না।
ঠিক আছে পাওয়ার বাড়াচ্ছি। বারো, তেরো, চৌদ্দ ডিবি। এখন কিছু টের পাচ্ছেন?
আমি কিছুই টের পেলাম না, শুধু হঠাৎ করে একটা দুর্গন্ধ নাকে ভেসে এল। বললাম, না, কিছুই টের পাচ্ছি না। তবে কোথা থেকে জানি দুর্গন্ধ আসছে।
সায়রা অবাক হয়ে বলল, দুর্গন্ধ?
হ্যাঁ।
কী রকম দুর্গন্ধ?
ইঁদুর মরে গেলে যেরকম দুর্গন্ধ হয়।
সায়রা এদিক-সেদিক শুঁকে বলল, নাহ কোনো দুর্গন্ধ নেই তো? যাই হোক, পরে দেখা যাবে দুর্গন্ধ কোথা থেকে আসছে। এখন আমার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটরটা পরীক্ষা করি। আপনি যেহেতু কোনো কিছু টের পাচ্ছেন না, সিগন্যালটা আরেকটু বাড়াই। এই যে ষোলো-সতেরো-আঠারো ডিবি।
হঠাৎ একটা বিদঘুটে জিনিস ঘটে গেল-কোথা থেকে একটা মরা ইঁদুর কিংবা ব্যাঙ লাফিয়ে আমার মুখের ভেতর ঢুকে গেল। প্রচণ্ড দুর্গন্ধে আমার বমি এসে যায়। আমি ওয়াক থু করে মুখ থেকে মরা ব্যাঙ কিংবা ইঁদুরটা বের করতে চেষ্টা করলাম কিন্তু বের করতে পারলাম না। হাত-পা বাঁধা, তাই হাত দিয়েও টেনে বের করতে পারলাম না। আমি গোঙানোর মতো শব্দ করতে লাগলাম। সায়রা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
মুখের ভিতরে
মুখের ভিতরে কী?
কী যেন একটা ঢুকে গেছে। পচা ইঁদুর, না হয় ব্যাঙ। ছি, কী দুর্গন্ধ! আমি প্রায় বমি করে দিচ্ছিলাম।
সায়রা আমার কাছে এসে মুখের ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, না! আপনার মুখে তো কিছু নেই। সব আপনার কল্পনা।
আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম না, না, আছে। ভালো করে দেখেন। আমি মুখ বড় করে হাঁ করলাম।
সায়রা বলল, আপনার চমৎকার একটা স্বাদের অনুভূতি পাওয়ার কথা। যতক্ষণ না পাচ্ছেন ততক্ষণ পাওয়ার বাড়াতে থাকি।
আমি চিৎকার করে না করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সায়রা আমার কথা শুনল না। হ্যান্ডেলটা টেনে পাওয়ার আরো বাড়িয়ে দিল। আর আমার মনে হল কেউ যেন আমাকে হাঁ করিয়ে এক বালতি পচা গোবর আমার গলা দিয়ে ঠেসে দিতে রু করেছে। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চাইল, ছটফট করে আমি একটা গগনবিদারী চিৎকার দিলাম। আমার চিৎকার শুনে সায়রা নিশ্চয়ই হ্যান্ডেলটা নামিয়ে স্টিমুলেটরের পাওয়ার বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন হঠাৎ করে ম্যাজিকের মতো পচা গোবর, মরা ইঁদুর আর ব্যাঙ, দুর্গন্ধ সবকিছু চলে গেল। আমি এত অবাক হলাম যে বলার মতো নয়-রাগ হলাম আরো বেশি। সায়রার দিকে চোখ পাকিয়ে বললাম, আপনার এই যন্ত্র মোটেই কাজ করছে না। ভালো স্বাদ পাবার কথা অথচ পচা দুর্গন্ধ পাচ্ছি।
সায়রা চোখ বড় বড় করে বলল, কী বলছেন আপনি! ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর পুরোপুরি কাজ করছে। শুধুমাত্র ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশন দিয়ে আপনাকে স্বাদের অনুভূতি দিয়েছি। ভালো না থোক খারাপ তো দিয়েছি।
সেটা এক জিনিস হল?
এক না হলেও কাছাকাছি।
পচা ইঁদুরের স্বাদ আর পোলাওয়ের স্বাদ কাছাকাছি হতে পারে?
সায়রা বিশ্ব জয় করার মতো একটা ভঙ্গি করে বলল, হতে পারে। ব্রেনের যে অংশে স্বাদের অনুভূতি সেখানে ভালো আর খারাপ অনুভূতি খুব কাছাকাছি। খারাপটা যখন পেয়েছি কাছাকাছি খুঁজলে ভালোটাও পাব।
খুঁজলে? কীভাবে খুঁজলে?
ট্রায়াল এন্ড এরর। আপনার ব্রেনে যেখানে স্টিমুলেশন দিয়েছি, এখন তার থেকে একটু সরিয়ে অন্য জায়গায় দেব। সেখানে না হলে অন্য জায়গায়, এভাবে খোঁজাখুঁজি করলেই পেয়ে যাব।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি রাজি না। আমার ব্রেনে আপনাকে আমি আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেব না।
সায়রা মধুরভাবে হেসে বলল, আপনি এটা কী বলছেন? এত আগ্রহ নিয়ে ভলান্টিয়ার হয়েছেন অথচ এখন বলছেন রাজি না। বিজ্ঞানের জগতে এটা জানাজানি হয়ে গেলে কী হবে আপনি জানেন?
যা হয় হোক।
ছেলেমানুষি করবেন না জাফর ইকবাল সাহেব বলে সায়রা আমার মাথার কাছে এসে মাথায় লাগানো হেলমেটটার মাঝে কী একটা করতে লাগল। খানিকক্ষণ পর তার যন্ত্রপাতিগুলোর কাছে ফিরে গিয়ে বলল-এখন অন্য জায়গায় গিয়ে স্টিমুলেশন দিচ্ছি। দেখি কী হয়?
আমি প্রচণ্ড রেগেমেগে বললাম, না, কিছুতেই না।