আমাকে দেখে সায়রার মুখ এক শ ওয়াট বাল্বের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দরজা খুলে বলল, এই তো আমার গিনিপিগ চলে এসেছে।
আমি থতমত খেয়ে বললাম আসলে আনতে পারি নাই। কাঁচাবাজারে খোঁজ করেছিলাম, সেখানে নাই।
কী নাই?
গিনিপিগ।
সায়রা আমার কথা শুনে হি হি করে হেসে উঠল, মেয়েটা হাসে কম, কিন্তু যখন হাসে তখন দেখতে বেশ ভালোই লাগে। আমি বললাম, হাসছেন কেন?
আপনার কথা শুনে।
আমি কি হাসির কথা বলেছি?
হ্যাঁ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কখন?
এই যে আপনি বললেন, কাঁচাবাজার থেকে গিনিপিগ আনতে চেয়েছেন। এটাই হাসির কথা–কারণ কাঁচাবাজার থেকে গিনিপিগ আনতে হবে না। আপনিই গিনিপিগ!
আমি থতমত খেয়ে বললাম, আমিই গিনিপিগ?
যার ওপরে এক্সপেরিমেন্ট করা হয় সে হচ্ছে গিনিপিগ। আপনার ওপর আমার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটরটা পরীক্ষা করব–তাই আপনি হবেন আমার গিনিপিগ।
আমি আঁতকে উঠে বললাম, আমার ওপরে পরীক্ষা করবেন?
তা না হলে কার ওপরে করব? কে রাজি হবে?
যুক্তিটার মাঝে কিছু গোলমাল আছে, কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি চিন্তা করতে পারি না, তাই এবারেও গোলমালটা ধরতে পারলাম না। আমতা-আমতা করে বললাম, ইয়ে মানে ব্রেনের মাঝে স্টিমুলেশন-কোনো সমস্যা হবে না তো?
এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপার, কখন কী সমস্যা হয় সেটা কি কেউ আগে থেকে বলতে পারে? পারে না।
তা হলে?
সায়রা মুখ গম্ভীর করে বলল, আমিও সেটা বলতে চাচ্ছি। ব্রেনের মাঝে সরাসরি স্টিমুলেশন দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা? লেভেলের তারতম্য হতে পারে, বেশি হয়ে যেতে পারে, ব্রেন ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে-সেটা টেস্ট করার জন্য আমি ভলান্টিয়ার কোথায় পাব? সারা পৃথিবীতে কেউ রাজি হত না। তখন হঠাৎ আপনার কথা মনে পড়ল-আপনাকে ই-মেইল পাঠালাম, আপনি এক কথায় রাজি হয়ে চলে এলেন। কী চমৎকার ব্যাপার।
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, না, মানে ইয়ে-বলছিলাম কী-
সায়রা বলল, না না আপনার কিছু বলার দরকার নেই, আমি জানি আপনি কী বলবেন। আপনি বলতে চাইছেন যে আপনি বিজ্ঞানের বও জানেন না কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য আপনি জীবন পর্যন্ত দিতে রাজি আছেন। ঠিক কি না?
আমি ঢোক গিলে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। সায়রা মধুর ভঙ্গিতে হেসে বলল, বিজ্ঞানের উন্নতি কি একদিনে হয়েছে? হয় নি। হাজার হাজার বছর লেগেছে। আমরা শুধু বিজ্ঞীদের নাম জানি কিন্তু এই হাজার হাজার বছর ধরে যে লক্ষ লক্ষ ভলান্টিয়ার বিজ্ঞানের জন্য তাদের জীবন দিয়েছে তাদের নাম আমরা জানি না। জানার চেষ্টাও করি না
ভ-ভ-ভলান্টিয়াররা মারা যায়?
যায় না? অবশ্যই যায়। সায়রা মৃদু হেসে বলল, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চাই না-আপনি নার্ভাস হয়ে যাবেন। আসেন আমার সাথে।
তেলাপোকা যেভাবে কাঁচপোকার পিছু পিছু যায় আমি অনেকটা সেভাবে সায়রার পিছু পিছু তার ল্যাবরেটরি ঘরে গেলাম। একটা টেবিলের উপর নানারকম যন্ত্রপাতি। মনিটরে নানারকম তরঙ্গ খেলা করছে, নানারকম আলো জ্বলছে এবং নিবছে। যন্ত্রপাতিগুলো থেকে ভোঁতা এক ধরনের শব্দ বের হচ্ছে। টেবিলের পাশে ডেন্টিস্টের চেয়ারের মতো একটা চেয়ার। তার কাছে একটা টুল, সেই টুলে মোটরসাইকেল চালানোর সময় যেরকম হেলমেট পরে সেরকম একটা হেলমেট। হেলমেট থেকে নানা ধরনের তার বের হয়ে এসেছে, সেগুলো যন্ত্রপাতির নানা জায়গায় গিয়ে লেগেছে। সায়রা হেলমেটটা দেখিয়ে বলল, এই যে জাফর ইকবাল সাহেব, এইটা হচ্ছে আমার নিজের হাতে তৈরি ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর।
ট্রা-ট্রা-ট্রা- আমি কয়েকবার যন্ত্রটার নাম বলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, কী হয় এই যন্ত্রটা দিয়ে?
মনে আছে, খাবারের স্বাদ নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম?
হ্যাঁ, মনে আছে।
মনে আছে, আমি বলেছিলাম ব্রেনের নির্দিষ্ট কোনো একটা জায়গায় স্টিমুলেশন দিয়ে খাবারের স্বাদ পাওয়া সম্ভব?
হ্যাঁ, মনে আছে।
মনে আছে, তখন বিল্টু বলেছিল সেটা করার জন্যে ব্রেন সার্জারি করে ব্রেনের ভেতরে কোন ধরনের ইলেকট্রড বসাতে হবে?
আমি আবার মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ, মনে আছে।
সায়রা একগাল হেসে বলল, আসলে ব্রেনের ভেতরে গিয়ে স্টিমুলেশন দিতে হবে না। বাইরে থেকেই দেওয়া সম্ভব।
বাইরে থেকেই?
হ্যাঁ। খুব হাই ফ্রিকোয়েন্সির ম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে বাইরে থেকে ব্রেনের ভিতরে স্টিমুলেশন দেওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে কি, যন্ত্রটা এর মাঝে আবিষ্কার হয়ে গেছে। আমেরিকার ল্যাবরেটরিতে সেটা ব্যবহার হয়। যন্ত্রটার নাম ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর। এটা কীভাবে তৈরি করতে হয় সেটা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে এনে এখানে তৈরি করেছি। সবকিছু রেডিএখন শুধু পরীক্ষা করে দেখা।
পরীক্ষা করে দেখা?
হ্যাঁ। আপনার মাথায় লাগিয়ে হাই ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাগনেটিক ফিল্ড দেব–আপনি এক ধরনের স্বাদ অনুভব করতে থাকবেন। মনে হবে পোলাও পাচ্ছেন।
যদি মনে না হয়? আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, যদি অন্য কিছু হয়?
তা হলে সেটা দেখতে হবে অন্য কী হচ্ছে। কেন হচ্ছে? কীভাবে হচ্ছে, এটাই হচ্ছে গবেষণা। এটাই হচ্ছে বিজ্ঞান।
আমার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু সায়রার সামনে আমি না করতে পারলাম না। আমাকে রীতিমতো জোর করে ডেন্টিস্টের চেয়ারে বসিয়ে সে বলল, চেয়ারের হাতলে হাত রাখেন।