আমাদের খাওয়ার দাওয়াতটা মোটামুটিভাবে মাঠে মারা গেল বলা যায়। ব্রেনের ভেতরে স্টিমুলেশন দেওয়ার কথা সায়রার মাথায় আসার পর থেকে সে অন্যমনস্ক হয়ে রইল, ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে লাগল এবং মাঝে মাঝে মাথা নাড়তে লাগল। আমরা তাকে আর ঘাটালাম না, বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
বিল্টু আর আমি একটা ফাস্টফুডের দোকান থেকে হ্যাঁমবার্গার খেয়ে সে রাতে বাসায় ফিরেছিলাম।
.
বিজ্ঞানের ব্যাপারে আমি আগে যেরকম হাবাগোবা ছিলাম এখন আর সেরকম বলা। যাবে না। সায়রা সায়েন্টিস্টের সাথে পরিচয় হওয়ার জন্যই হোক আর বিল্টুর জ্বালাতনের কারণেই হোক আমি মোটামুটিভাবে বিজ্ঞানের লাইনে এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছি। সেদিন বাথরুমের বা ফটাশ শব্দ করে ফিউজ হয়ে গেল। আমি একটুও না ঘাবড়ে একটা বাল্ব কিনে নিজে লাগিয়ে দিলাম আমার জীবনে প্রথম। বিল্টু একদিন আমাকে দেখিয়ে দিল, তারপর থেকে আমি নিজে মোড়ের একটা সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ই-মেইল পাঠানো শুরু করে দিয়েছি। প্রথমে পাঠানোর লোক ছিল মাত্র দুজন-সায়রা সায়েন্টিস্ট আর বিল্টু। বিল্টু আরেকদিন আমাকে শিখিয়ে দিল কেমন করে অন্য মানুষের ই-মেইল বের করতে হয়- সেটা জানার পর আমি অনেক জায়গায় ই-মেইল পাঠাতে রু করে দিলাম। প্রথমেই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে খুব কড়া ভাষায় তাদের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করার জন্য উপদেশ দিয়ে একটা ই-মেইল পাঠিয়ে দিলাম। জার্মানির চ্যান্সেলরের কাছে ই-মেইল পাঠিয়ে তাদের ইমিগ্রেশন পলিসি ঠিক করার জন্য অনুরোধ করলাম। ব্রাজিল ওয়ার্ল্ডকাপে জিতে যাবার পর তাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে ই-মেইল পাঠিয়ে লিখে দিলাম, শুধু ফুটবল খেললেই হবে না-পড়াশোনাতেও মনোযোগ দিতে হবে, কারণ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের দেশের মন্ত্রীদের বোকামির তালিকা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা ই-মেইল পাঠাব ভাবছিলাম কিন্তু সবাই নিষেধ করল। তা হলে নাকি এসএসএফ-এর লোকজন এসে কঁ্যাক করে ধরে ডিবি পুলিশের হাতে দিয়ে দিবে। তারা রিমান্ডে নিয়ে রামধোলাই দিয়ে অবস্থা কেরোসিন করে দেবে। তবে আমি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পত্রিকায় ই-মেইলে সম্পাদকদের কাছে চিঠি পাঠাতে লাগলাম। কয়েক দিনের মাঝেই দৈনিক মোমের আলো পত্রিকায় একটা চিঠি পা হয়ে গেল। চিঠিটা এরকম–
শৃঙ্খলাবোধ এবং জাতির উন্নতি
পৃথিবীর সকল জাতি যখন উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করিতেছে তখন আমরা শৃঙ্খলাবোধের অভাবে ক্রমাগত পশ্চাদমুখী হইয়া পড়িতেছি। উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায়, ট্রাফিক সার্জেন্ট যখন রাস্তার মোড়ে একটি ট্রাক ড্রাইভারকে আটক করিয়া ঘুষ আদায় করে তখন কখনো পঞ্চাশ কখনো এক শ কখনো-বা দুই শ টাকা দাবি করেন। ট্রাক ড্রাইভাররা এই অর্থ দিতে গড়িমসি করেন। ইহাতে ট্রাফিক সার্জেন্টদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। তাহারা তাহাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে পারেন না। আন্তর্জাতিক টেন্ডার পাওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রী মহোদয়দের ঘুষ দেওয়া হইতে রু করিয়া সচিবালয়ের পিয়নদেরকে পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। ঘুষের রেট নির্ধারিত নয় বলিয়া দর কষাকষি করিতে হয়। উভয় পক্ষের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়।
কাজেই আমি প্রস্তাব করিতেছি-অবিলম্বে ঘুষের রেট নির্ধারণ করিয়া জাতীয় সংসদে পাস করানোর পর তাহা সরকারি গেজেটভূক্ত করিয়া দেওয়া হোক। যাহারা এই রেট অনুযায়ী ঘুষ দিতে আপত্তি করিবেন তাহাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। পুরো প্রক্রিয়াটি একটি শৃখলার ভিতরে আনিয়া জাতিকে উন্নতির দিকে অগ্রসর করানোর পথ সুগম করানো হোক।
জাফর ইকবাল
পল্লবী, মিরপুর
শুধু যে পত্রিকায় ই-মেইল ব্যবহার করে চিঠি পাঠাতে শুরু করলাম তা নয়, পরিচিত লোকজনকে আমার নতুন প্রতিভার কথা জানাতে শুরু করলাম। নতুন কারো সাথে পরিচয় হলেই তার ই-মেইল অ্যাড্রেস কী জিজ্ঞেস করতে শুরু করলাম এবং ই-মেইল অ্যাড্রেস না থাকলে সেটি নিয়ে বাড়াবাড়ি ধরনের অবাক হতে শুরু করলাম।
আমি যত ই-মেইল পাঠাতে শুরু করলাম সেই তুলনায় উত্তর আসত খুব কম। বিন্দু এবং সায়রা ছাড়া আর কেউ উত্তর দিত না, তাদের উত্তরও হত খুব ছোট তিন-চার শব্দের। তবুও যেদিন একটা ই-মেইল পেতাম আমি উৎসাহে টগবগ করতে শুরু করতাম, রক্ত চনমন করতে করত। সায়রার বাসায় সেই দাওয়াত কেলেঙ্কারির প্রায় এক মাস পর হঠাৎ তার কাছ থেকে একটা ই-মেইল পেলাম, সেটাকে বাংলায় অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায়-
মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন সমস্যা সমাধান।
ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর। প্রোটোটাইপ প্রস্তুত।
গিনিপিগ প্রয়োজন। দেখা করুন। জরুরি।
সায়রা
সায়রার ই-মেইল বোঝা খুব কঠিন–বিল্টুর কাছে নিয়ে গেলে হয়তো মর্মোদ্ধার করে দিত কিন্তু আমি আর তাকে বিরক্ত করতে চাইলাম না। অনেকবার পড়ে আমার মনে হল, সে একটা যন্ত্র তৈরি করেছে যেটা পরীক্ষা করার জন্য গিনিপিগ দরকার। সে দেখা করতে বলেছে। গিনিপিগসহ নাকি গিনিপিগ ছাড়া যেতে বলেছে ঠিক বুঝতে পারলাম না। এক হালি গিনিপিগ নিয়েই যাব যাব চিন্তা করে কাঁচাবাজারে বিকেলবেলা খুঁজে দেখলাম, কেউ জিনিসটা চিনতেই পারল না। অনেক ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত গিনিপিগ ছাড়াই সায়রার বাসায় হাজির হলাম।