বিল্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ফার্স্ট ক্লাস? কী বলছ মামা! খাবার মুখে দেওয়া যায় না। কোনো স্বাদ নাই।
বিল্টুকে থামানোর জন্য আমি টেবিলের তলা দিয়ে তার পায়ে লাথি মারার চেষ্টা করলাম, লাথিটা লাগল সায়রার পায়ে এবং সে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। বিল্টু অবিশ্যি ভ্রূক্ষেপ করল না, বলল, সায়রা খালা, আপনার মেশিনের রান্নার স্বাদ যদি এরকম হয় তা হলে তার একটাও বিক্রি করতে পারবেন না।
সায়রা খানিকক্ষণ হতচকিত হয়ে বিল্টুর দিকে তাকিয়ে থেকে ইতস্তত করে বলল, আমি তো আসলে ঠিক বিক্রি করার জন্য এটা আবিষ্কার করি নাই। এটা আবিষ্কার করেছি নারী জাতিকে রান্নাঘর থেকে মুক্ত করার জন্য।
কীভাবে কথাবার্তা বলতে হয় সেটা যে বিকে শেখানো হয় নি আমি এবারে সেটা আবিষ্কার করলাম, সে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এটা দিয়ে নারী জাতির মুক্তি হবে না সায়রা খালা, বরং উল্টোটা হতে পারে।
উল্টোটা?
হ্যাঁ। যে এটা দিয়ে রান্না করবে তাকে ধরে সবাই পিটুনি দিতে পারে। গণপিটুনি।
আমি এবারে ভাবনাচিন্তা করে বিল্টুর পা কোনদিকে নিশ্চিত হয়ে একটা লাথি কশালাম। বিল্টু ককিয়ে উঠে বলল, উহ! মামা লাথি মারলে কেন?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, লাথি মারি নি। পা লেগে গেছে।
খাবার টেবিলে বসে তুমি কি পা দিয়ে ফুটবল খেল? এত জোরে পা লেগে যায়!
সায়রার চোখ এড়িয়ে আমি বিল্টুর চোখে চোখ রেখে একটা সিগন্যাল দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনো লাভ হল না। বিল্টু বলতেই লাগল, সায়রা খালা, তোমার এই মেশিন বিক্রি করলে লাভ থেকে ক্ষতি হবে বেশি।
কেন?
কারণ কেউ এর রান্না খাবে না। যদি কাউকে খাওয়াতে চাও তোমাকে টাকাপয়সা দিয়ে খাওয়াতে হবে। এক প্লেট ভাত দশ টাকা এক বাটি ডাল বিশ টাকা। ডিমভাজি পঞ্চাশ টাকা। কমপক্ষে সত্তর টাকা।।
আমি আর না পেরে বিল্টুকে ধমক দিয়ে বললাম, কী আজেবাজে কথা বলছিস বিল্টু? সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা?
বিলু গম্ভীর হয়ে বলল, না মামা, আমি একটুও ঠাট্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি। একেবারে কিরে কেটে বলছি।
আমি খাচ্ছি না? আমি জোর করে মুখে কয়েক লোমা ভাত ঠেসে দিয়ে বললাম, আমার তো খেতে বেশ লাগছে!
তোমার কথা আলাদা মামা। তুমি নিশ্চয়ই পাগল। আম্মা সব সময় বলে তোমার জন্মের সময় ব্রেনে নাকি অক্সিজেন সাপ্লাই কম হয়েছিল, সেজন্য তুমি কোনো কিছু বোঝ না।
সায়রাকে বেশ চিন্তিত দেখাল। সে একটা বড় কাগজ দেখতে দেখতে বলল, আমার মেশিনের রিপোর্ট তো ঠিকই দিয়েছে। এই দেখেন-ডিমভাজার সালফার কন্টেন্ট লিমিটের মাঝে। ডালের পিএইচ পারফেক্ট। ভাতের সারফেস টেক্সচার অপটিমাম।
আমি উৎসাহ দেবার জন্য বললাম, মেশিন যেহেতু বলেছে ঠিক, এটা অবিশ্যি ঠিক। বিল্টু সেদিনের ছেলে, সে কী বোঝে? তার কোনো কথা শুনবেন না।
বিল্টু মুখ বাকিয়ে বলল, সব ঠিক থাকতে পারে কিন্তু কোনো স্বাদ নাই।
সায়রা হঠাৎ করে অন্যমনস্ক হয়ে গেল, কিছুক্ষণ কী একটা ভেবে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা জাফর ইকবাল সাহেব, স্বাদ মানে কী?
হঠাৎ করে এরকম একটা জটিল প্রশ্ন শুনে আমি একেবারে ঘাবড়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম, স্বাদ মানে হচ্ছে-যাকে বলে-আমরা যখন খাই তখন মানে- ইয়ে-যাকে বলে–
আরো কিছুক্ষণ হয়তো এরকম আমতা-আমতা করতাম কিন্তু সায়রা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এটা হচ্ছে একটা অনুভূতি। আমরা যখন কিছু খাই তখন জিব তার একটা অনুভূতি পায়, নাক একটা গন্ধ পায়। দাঁত-মাঢ়ী এক ধরনের স্পর্শ অনুভব করে, তার সবগুলো নার্ত দিয়ে আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায়। সেখানে নিউরনে এক ধরনের সিনান্স কানেকশন হতে থাকে। মস্তিষ্কের সেই অনুভূতি থেকে আমরা বলি স্বাদটি ভালো কিংবা স্বাদটি খারাপ।
সায়রার চোখ দুটো এক ধরনের উত্তেজনায় জ্বলজ্বল প্রতে থাকে। আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে বুঝতে পারছেন?
আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে বললাম, না।
তার মানে একটা জিনিসের স্বাদ ভালো করার জন্য কষ্ট করে সেটাকে ভালো করে রান্না করার দরকার নেই। আমরা যদি খুঁজে বের করতে পারি ব্রেনের কোন জায়গাটাতে আমরা খাবারের স্বাদ অনুভব করি সেখানে যদি আমরা এক ধরনের স্টিমুলেশন দিই তা হলে আমরা যেটা খাব সেটাকেই মনে হবে সুস্বাদু।
বিল্টু চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি?
এক শ বার সত্যি। তার মানে আমি যদি সেরকম একটা মেশিন তৈরি করতে পারি যেটা দিয়ে ব্রেনের নির্দিষ্ট জায়গায় স্টিমুলেশন দেওয়া যায় তা হলে খবরের কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেলে মনে হবে কোরমা-পোলাও খাচ্ছি!
আমি চমকে উঠে বললাম, খবরের কাগজ?
হ্যাঁ। স্পঞ্জের স্যান্ডেল খেলে মনে হবে সন্দেশ খাচ্ছেন। কেরোসিন খেলে মনে হবে অরেঞ্জ জুস খাচ্ছেন। পৃথিবীতে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া যাবে!
বিল্টু ঢোক গিলে বলল, কিন্তু সেটা মাথার ভেতরে বসানোর জন্য আপনাকে ব্রেনের অপারেশন করতে হবে! আপনাকে আগে ব্রেনের সার্জারি শিখতে হবে। যদি শিখেও যান তারপরও আমার মনে হয়।
সায়রা ভুরু কুঁচকে বলল, কী মনে হয়?
খবরের কাগজ, স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর কেরোসিন খাবার জন্য কেউ ব্রেনের সার্জারি করতে রাজি হবে না।
রাজি হবে না?
উঁহু।
সায়রাকে হঠাৎ খুব চিন্তিত মনে হল।