আমি ধমক দিয়ে বললাম, মেশিন যেটা রাঁধে সেটাই তো খাবি, গাধা কোথাকার!
বিল্টু মুখটা প্যাচার মতো করে বলল, বিরিয়ানি রাঁধতে পারে এরকম একটা মেশিন তৈরি করলেন না কেন সায়রা খালা?
সায়রা কিছু বলার আগেই আমি বললাম, বিরিয়ানিতে কত কোলেস্টেরল জানিস না বোকা? খেয়ে মারা যাবি নাকি?
সায়রা বলল, আস্তে আস্তে হবে। রান্নার বেসিক অপারেশন হচ্ছে তিনটা-সিদ্ধ, ভাজা এবং পোড়া। কাজেই যে মেশিন সিদ্ধ করতে পারে, ভাজতে পারে এবং পোড়াতে পারে, সেটা দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু রান্না করা যাবে। মেশিনের সামনে একটা ডায়াল থাকবে, সেখানে শুধু টিপে দেবে-ব্যস, অটোমেটিক রান্না হয়ে যাবে।
সবকিছু রান্না হবে?
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যই সবকিছু রান্না হবে।
বিল্টু মুখ গম্ভীর করে বলল, আপনার এমন একটা মেশিন তৈরি করা উচিত যেটা সবজি রাধবে না, দুধ গরম করবে না। তা হলে দেখবেন সেটা কত বিক্রি হবে! বাচ্চারা পাগলের মতো কিনবে।
আমি বিল্টুকে ধমক দিয়ে বললাম, থাক তোকে আর উপদেশ দিতে হবে না।
সায়রা একটু হাসল। তাকে আমি হাসতে দেখেছি খুব কম। আমি আবিষ্কার করলাম সে হাসলে তাকে বেশ সুন্দর দেখায়।
আমি বললাম, চলেন আপনার যন্ত্রটা দেখি।
চলেন।
ঘরের মাঝামাঝি প্রায় ছাদ-সমান উঁচু বিশাল একটা যন্ত্র। নানা রকমের বাতি জ্বলছে এবং নিবছে। উপরে বেশ খানিকটা অংশ স্বচ্ছ, সেখানে অনেকগুলো খোপ। খোপগুলোর একেকটাতে একেকটা জিনিস। কোনোটাতে চাল, কোনোটাতে ডাল, কোনোটাতে ডিম। এ ছাড়াও আছে পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ, লবণ এবং তেল। সামনে একটা ডায়াল, সেখানে লেখা-ভাত, ডাল এবং ডিমভাজি। সায়রা জিজ্ঞেস করল, আগে কোনটা রাঁধব?
আমি কিছু বলার আগেই বিল্টু বলল, ডিমভাজি। ঠিক আছে। সায়রা ডায়ালটা দেখিয়ে বলল, এখানে চাপ দাও।
বিল্টু ডায়ালটা চেপে ধরল-সাথে সাথে মনে হল মেশিনের ভেতর ধুন্ধুমার কাজ শুরু হয়ে গেল। ডিমের খোপ থেকে ডিমগুলো গড়িয়ে আসতে থাকে বিশাল একটা পাত্রে। সেগুলো টপটপ করে পড়ে ভেঙে যেতে থাকে। ছাঁকনির মতো একটা জিনিস ডিমের খোসাগুলোকে তুলে নেয় এবং বিশাল একটা ঘুটনির মতো জিনিস সেটাকে খুঁটতে শুরু করে। অন্য পাশ থেকে পো পো করে একটা শব্দ হয় এবং প্রায় কয়েক কেজি পেঁয়াজ গড়িয়ে। আসতে থাকে, মাঝামাঝি আসতেই ধারালো একটা তরবারির মতো জিনিস পেঁয়াজটাকে কুপিয়ে ফালাফালা করে দেয়। সেটা শেষ হবার সাথে সাথে কাঁচা মরিচ নেমে আসে এবং ছোট একটা চাকু সেটাকে কুচি কুচি করে ফেলে। উপরে কী একটা খুলে যায় এবং ঝুরঝুর করে খানিকটা লবণ এসে পড়ল। হঠাৎ সাইরেনের মতো একটা শব্দ হতে থাকল, দেখলাম বিশাল একটা কড়াইয়ের ভেতর গলগল করে প্রায় দুই লিটার তেল এসে পড়ল। বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হল এবং কড়াইয়ের নিচে হঠাৎ ফার্নেসের মতো আগুনের শিখা বের হয়ে এল। দেখতে দেখতে তেল ফুটতে থাকে এবং বিদঘুটে একটা শব্দ করে খুঁটে রাখা ডিম সেখানে ফেলে দেওয়া হল। প্রচণ্ড শব্দ করে ডিম ভাজা হতে থাকে। সারা ঘর ভাজা ডিমের গন্ধে ভরে যায়। সায়রা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল, এবারে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, সাবধান! সবাই দূরে সরে যান।
বিল্টু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন সায়রা খালা?
ডিমভাজিটা এখন প্লেটে ছুঁড়ে দেবার চেষ্টা করবে, মাঝে মাঝে মিস করে, তখন বিপদ হতে পারে।
ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভয়ংকর, কারণ উপরে অ্যাম্বুলেন্সের মতো লালবাতি জ্বলতে ঔ করে। মাঝামাঝি একটা জায়গায় কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যায়, দশ নয় আট সাত…।
আমরা দূরে সরে গিয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে রইলাম। হঠাৎ প্রচও একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হল এবং মনে হল বিছানার ভোশকের মতো হলুদ রঙের একটা জিনিস আকাশের দিকে ছুটে গেল। চাকার মতো সেটা ঘুরতে থাকে-ঘুরতে ঘুরতে সেটা ঘরের এক কোনায় বিশাল এক গামলার মাঝে এসে পড়ল। সায়রা হাততালি দিয়ে বলল, পারফেক্ট ল্যান্ডিং।
আমি আর বি সায়রার পিছু পিছু ডিমভাজিটা দেখতে গেলাম। এর আগে আমি কিংবা মনে হয় পৃথিবীর আর কেউ এত বড় ডিমভাজি দেখে নি। আড়াআড়িভাবে এটা পচ ফিট থেকে এক ইঞ্চি কম হবে না। আমি আমতা-আমতা করে বললাম, এত বড় ডিমভাজি?
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, আস্তে আস্তে মেশিনটা ছোট করতে হবে। প্রথমে শুরু করার জন্য সব সময় একটা বড় মডেল তৈরি করতে হয়।
বিল্টু ভয়ে ভয়ে বলল, আমাদের পুরোটা খেতে হবে?
সায়রা হেসে বলল, না না, পুরোটা খেতে হবে না। যেটুকু ইচ্ছে হবে সেটুকু খাবে।
বিল্টু খুব সাবধানে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এই ডিমভাজিটা কমপক্ষে চল্লিশ জন খেতে পারবে।
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। এটা তো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, সবকিছু বেশি বেশি করে হয়।
সায়রা যে মিথ্যে বলে নি একটু পরেই তার প্রমাণ পেলাম-কারণ রান্না করার পর ভাত এবং ডাল ডাইনিং রুমে বড় বড় বালতি করে আনতে হল। আমরা খাবার টেবিলে খেতে বসেছি-চামচ দিয়ে মেঝেতে রাখা বালতি থেকে ভাত-ডাল তুলে নিতে হল। ডিমভাজি চাকু দিয়ে কেটে আলাদা করতে হল।
আমরা খেতে করা মাত্রই সায়রা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে?
মিথ্যে কথা বললে পাপ হয় এবং সেই পাপের কারণে নাকি দোজখের আগুনে শরীরের নানা অংশ পুড়তে থাকবে, কিন্তু আমার ধারণা-কারো মনে কষ্ট না দেবার জন্য মিথ্যে কথা বললে পাপ হয় না। আমি খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছি এরকম ভান করে বললাম, খুব ভালো হয়েছে। একেবারে ফার্স্ট ক্লাস।