আমি বললাম, জি খুব ভালো টাইম দেয়। প্রতি ঘণ্টায় শব্দ করে।
শব্দের খেতা পুড়ি-বলে কাউলা ঘড়িটা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে গুঁড়ো করে ফেলল।
ওস্তাদ পা নাচানো বন্ধ করে মেঘের মতো গর্জন করে বলল, কাউলা?
জে ওস্তাদ।
তুই এইটা কী করলি? তোরে কতবার বলেছি অপারেশন করার সময় রাগ করতে। পারবি না। মাথা ঠাণ্ডা রাখবি। রাগ করলেই কামকাজে ভুল হয়, বিপদ হয়। বলি নাই তোরে?
জে, বলেছেন ওস্তাদ।
এই মানুষ চরম হাবাগোবা-এর সামনে খুব সাবধান।
গত পরশু যে চাকু মারলাম একজনরে—
চাকু মারা ঠিক আছে। ভাবনাচিন্তা করে ঠাণ্ডা মাথায় বাড়ির মালিকরে চাকু মারতেই বউ স্টিলের আলমারির চাবি দিয়ে দিল। এখানে তুই রাগ করে ঘড়িটা গুঁড়া করে দিলি তাতে কী লাভ হল?
কাউলা আমাকে দেখিয়ে বলল, এরে একটা চাকু মারা ঠিক আছে?
ওস্তাদ উদাস গলায় বলল, মারতে চাইলে মার। চাকু মারায় খরচ নাই, গুলি নষ্ট হয়। পত্রিকায় খবর ওঠে, মানুষ ভয়ভীতি পায়, বিজনেসের জন্য ভালো। চাকু আছে সাথে?
কাউলা মাথা নাড়ল, বলল, জে না। বড় অপারেশন মনে করে কাটা রাইফেল নিয়ে বের হইছিলাম।
তা হলে?
কাউলা কিছুক্ষণ মাথা চুলকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কাছে আছে?
জি একটা আছে। বেশি বড় না। একটু ভোঁতা।
ভোঁতা? কাউলা খুব বিরক্ত হল, ভোঁতা চাকু কেউ ঘরে রাখে নাকি?
বাসায় একটা ভোঁতা চাকু রাখার জন্য আবার লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। কাউলা মুখ খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, চাকুটা কই?
রান্নাঘরে। ড্রয়ারের ভিতরে।
কাউলা খুব বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরে চাকু আনতে গেল। আমি আর ওস্তাদ চুপচাপ বসে আছি। আমি মশারির ভিতরে, ওস্তাদ চেয়ারের উপর। কোনো কথা না বলে দুইজন চুপচাপ বসে থাকা এক ধরনের অভদ্রতা-আমি তাই আলাপ চালানোর জন্য বললাম, ইয়ে-চাকু মারলে কি ব্যথা লাগে?
ওস্তাদ বলল, কোথায় মারে তার ওপর নির্ভর করে। পেটে মারলে বেশি লাগে না।
আপনারা কোথায় মারবেন?
সেইটা কাউলা জানে-তার কোথায় মারার শখ। হাত পাকে নাই এখনো, প্র্যাকটিস দরকার। ওস্তাদ আমাকে ভালো করে পরীক্ষা করে বলল, আপনাকে মনে হয় পেটেই মারবে। ভুঁড়িটা দেখে লোভ হয়।
ও। এরপর কী নিয়ে কথা বলা যায় চিন্তা করে পেলাম না। অবিশ্যি আর দরকারও ছিল না। কাউলা ততক্ষণে চাকু আর একটা বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে চলে এসেছে।
ওস্তাদ বিরক্ত হয়ে বলল, তোকে কতবার কইছি জিব্বাটারে সামলা? অপারেশনে গিয়ে কখনো খাইতে হয় না, কই নাই?
কইছেন ওস্তাদ।
তাইলে?
আপনার জন্য আনছি। কিরিম বিস্কুট।
ওস্তাদের মুখটা একটু নরম হল, বলল, ও, কিরিম বিস্কুট? দে তাইলে। ওস্তাদ আর কাউলা তখন টেবিলের দুই পাশে দুইটা চেয়ার নিয়ে বসে ক্রিম বিস্কুট খেতে লাগল। মাত্র গতকাল কিনে এনেছি, যেভাবে খাচ্ছে মনে হয় এক্ষুনি পুরো প্যাকেট শেষ করে ফেলবে।
মশারির ভেতরে বসে বসে আমি কাউলা আর তার ওস্তাদকে দেখতে লাগলাম, বিস্কুট খাওয়া শেষ করেই তারা আমার পেটে চাকু মারছে। কী সর্বনাশ ব্যাপার! আমি এখন কী করব? মশারিসহ তাদের ওপর লাফিয়ে পড়ব? চিৎকার করে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করব? হাত জোড় করে কাকুতি-মিনতি করব? নাকি সিনেমায় যেরকম দেখেছি নায়কেরা মারামারি করে সেভাবে মারামারি শুরু করে দেব?
কিন্তু আমার কিছুই করা লাগল না, তখন সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাপার ঘটল এবং সেটা ঘটাল একটা মশা। মশাটা সম্ভবত ওস্তাদের ঘাড়ে বসে কামড় দিয়ে খানিকটা রক্ত খাবার চেষ্টা করল, ওস্তাদ বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে মশাটাকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে বলল, ওহ! এই মশার যন্ত্রণায় মনে হয় চুরি-ডাকাতি ছেড়ে দিতে হবে।
ওস্তাদ, মশারে তাচ্ছিল্য কইরেন না। কাউলা বলল, ডেঙ্গু মশা বিডিআর থেকেও ডেঞ্জারাস।
ঠিকই কইছিস। ওস্তাদ এবারে মশাটাকে লক্ষ করে, তার নাকের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, দুই হাত দিয়ে সশব্দে সেটাকে থাবা দিয়ে মেরে ফেলল-হাততালি দেবার মতো একটা শব্দ হল তখন।
সাথে সাথে খাটের নিচে রাখা মালিশ মেশিনের দুইটা হাত চালু হয়ে যায়। সেটাকে প্রোগ্রাম করা আছে যেদিকে শব্দ হয়েছে সেদিকে এগিয়ে যাবার জন্য। কাজেই খাটের নিচে হাত দুটো আঙুল ভর করে এগিয়ে আসতে শুরু করল। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম সেগুলো মেঝে খামচে খামচে এগিয়ে যাচ্ছে।
ওস্তাদের কাছাকাছি গিয়ে চেয়ারের পা বেয়ে হাত দুটো উপরে উঠতে করেছে।
আমি নিশ্বাস বন্ধ করে রইলাম এবং দেখলাম মাথার কাছাকাছি গিয়ে হাত দুটো নিঃশব্দে হঠাৎ করে ওস্তাদের ঘাড় চেপে ধরল। ওস্তাদ চমকে গিয়ে চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল। খপ করে পিস্তলটা হাতে নিয়ে পিছনে তাকাল, পিছনে কেউ নেই। সে হতবাক হয়ে ঘুরে সামনে তাকাল, সামনেও কেউ নেই। কাউলা ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছে-ভয়ে তার চোয়াল ঝুলে পড়েছে, মুখ হাঁ হয়ে গেছে, গলায় কোথায় জানি একটা তাবিজ আছে সেই তাবিজটা ধরে কাঁপা গলায় বলল, কসম লাগে-জিন্দাপীরের কসম লাগে-আল্লাহর কসম লাগে।
ওস্তাদ হাত দিয়ে ঘাড়ে ধরে রাখা হাত দুটো ছোটানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সেগুলো লোহার মতো শক্ত, কারো সাধ্যি নেই ছোটায়। দুই হাতে ধরে টানাটানি করে ভয়ে চিৎকার করে বলল, কাউলা-হাত লাগা-বাচা আমারে