জে ওস্তাদ।
ভুল বাসা।
কাউলা নামের মানুষটা চমকে উঠে বলল, কী কন ওস্তাদ! ভুল বাসা?
হয় হারামজাদা। এই দ্যাখ। বলে মানুষটা মশারি তুলে আমাকে দেখাল।
আমি জানি, আমাকে দেখে মানুষজন খুব খুশি হয় না। কিন্তু এই মাঝরাতে আমাকে দেখে দুই ডাকাতের যা মনখারাপ হল সেটা আর বলার মতো নয়।
কাউলা বলল, হায় হায়। এইটা তো দেহি সেই হাবাগোবা মানুষটা!
ওস্তাদ চোখ লাল করে কাউলার দিকে তাকিয়ে বলল, হারামজাদা, একটা সহজ কাজ করতে পারস না? এত কষ্ট করে গ্রিল কাইটা ঢুকলাম আর অহন দেহি ভুল বাসা।
কাউলা মুখ কঁচুমাচু করে বলল, ভুল হয়ে গেছে ওস্তাদ! বাইরে থন মনে হইল দোতলা-আসলে তিন তলা।
এখন কী করবি?
আইছি যহন যা পাই লইয়া যাই।
তখন কাউলা এবং ওস্তাদ দুইজনেই আমার ঘরের চারপাশে তাকিয়ে একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওস্তাদ বলল, এর তো দেহি কিছুই নাই। একটা বাক্স পর্যন্ত নাই।
কাউলা বলল, খালি একটা টেলিভিশন
এতক্ষণ আমি কোনো কথাবার্তা বলি নাই, তাদের কথাবার্তায় আমার যোগ দেওয়াটা মনে হয় ঠিক ভদ্রতাও হত না, কিন্তু টেলিভিশনের ব্যাপারটা চলে আসায় আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, ইয়ে মানে টেলিভিশনটা নষ্ট।
ওস্তাদ বলল, নষ্ট? কেমন করে নষ্ট হল?
লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম। বাজে প্রোগ্রাম হচ্ছিল তো
ওস্তাদ এবং কাউলা মনে হয় প্রথমবার আমার দিকে ভালো করে তাকাল এবং আমি স্পষ্ট দেখলাম ওস্তাদের মুখটায় কেমন যেন ভয়ের ছাপ পড়ল। সে ঘুরে কাউলার দিকে তাকিয়ে বলল কাউলা, চল যাই।
চলে যাব?
হ্যাঁ। আমি কামকাজ শিখছি সুলেমান ওস্তাদের কাছে। সুলেমান ওস্তাদ কইছে কখনো হাবাগোবা মানুষের বাড়িতে চুরি-ডাকাতি করতে যাবি না।
কেন ওস্তাদ?
বিপদ হয়। অনেক বড় বিপদ হয়।
কাউলাকেও এবারে খুব চিন্তিত দেখাল। আমি আমার বাসায়, আমার বিছানায় মশারির ভেতরে জবুথবু হয়ে বসে আছি। আর দুইজন ডাকাত আমার দিকে দুশ্চিন্তা নিয়ে তাকিয়ে আছে পুরো ব্যাপারটার মাঝে একটা কেমন যেন অবিশ্বাসের ব্যাপার আছে। কাউলা কাছে এসে মশারিটা তুলে খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল-আমি মুখটাকে একটু হাসি হাসি করার চেষ্টা করলাম কিন্তু খুব একটা লাভ হল না।
কাউলা ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ওস্তাদ হাবাগোবা মানুষের বাড়িতে চুরি-ডাকাতি করলে বিপদ হয় কেন?
একজন মানুষ কখন কী করবে সেটা আন্দাজ করা যায়, তার জন্য রেডি থাকা যায়। কিন্তু বোকা মানুষ কখন কী করবে সেটা আন্দাজ করা যায় না। এরা একেবারে উল্টাপাল্টা কাজ করে সিস্টিম নষ্ট করে দেয়।
কাউলা চিন্তিতভাবে বলল, ওস্তাদ, বিপদ ডেকে লাভ আছে? গুলি কইরা ফিনিস কইরা দেই।
ওস্তাদ প্রস্তাবটা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, নাহ। গুলির অনেক দাম। বাজে খরচ করে লাভ নাই।
আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, আমার জানের দাম গুলি থেকে কম হওয়ায় মনে হয় এই যাত্রা বেঁচে গেলাম।
কাউলা বলল, এসেই যখন গেছি, যা পাই নিয়া নেই?
ওস্তাদ টেবিলের কাছে রাখা চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে উদাস গলায় বলল, নে।
কাউলা তখন আমার কাছে এগিয়ে আসে, হাতের বন্দুকটা দিয়ে মশারিটা উপরে তুলে বলল, টাকাপয়সা যা আছে দেন।
আমি তাড়াতাড়ি বালিশের নিচে থেকে মানিব্যাগটা বের করে সেখান থেকে সব টাকা বের করে কাউলার হাতেই দিয়ে দিলাম। কাউলা গুনে মুখ বিকৃত করে বলল, মাত্র সাতাইশ টাকা? তার মাঝে একটা দশ টাকার নোট ছিঁড়া?
সাতাশ টাকার মাঝে একটা নোট ছেঁড়া বের হওয়ার জন্য লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, খেয়াল করি নাই, এক রিকশাওয়ালা গছিয়ে দিয়েছে।
মাত্র সাতাইশ টাকা দিয়ে কী হইব? গ্রিল কাটার ভাড়া করছি দুই শ টাকা দিয়ে।
ওস্তাদ বলল, বাদ দে কাউলা বাদ দে।
বাদ দেই কেমন কইরা? কাউলা মহাখাপ্পা হয়ে বলল, বউয়ের সোনা গয়না
অলংকার কই?
আমি মাথা চুলকে বললাম, জি, এখনো বিয়ে করি নাই।
ওস্তাদ চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছিল। পা নাচানো বন্ধ করে বলল, এখনো বিয়া করেন। নাই?
জি না।
বয়স কত?
সার্টিফিকেটে পঁয়ত্রিশ। অরিজিনাল আরো দুই বছর বেশি।
সাঁইত্রিশ বছর বয়স এখনো বিয়া করেন নাই? তা হলে বিয়ে করবেন কখন? বুড়া হইলে?
সাঁইত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেল এখনো বিয়ে হয় নি সেজন্য আবার আমার লজ্জায় মাথা কাটা গেল। আমতা-আমতা করে বললাম, ইয়ে-চেষ্টা করে যাচ্ছি-কিন্তু কোনো মেয়ে রাজি হতে চায় না।
কাউলা অবিশ্যি বিয়ের আলাপে একেবারে উৎসাহ দেখাল না। আমার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, মূল্যবান আর কী আছে বাসায়?
জাহানারা ইমামের নিজের হাতে অটোগ্রাফ দেওয়া একটা বই আছে।
কাউলা কিছু না বুঝে ওস্তাদের দিকে তাকাল, ওস্তাদ হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, কাউলা, আয় যাই। হাবাগোবা মানুষের কাছাকাছি থাকা খুব বড় রিস্ক।
কাউলা অবিশ্যি তবু হাল ছাড়ল না, আমার দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, সত্যিকারের মূল্যবান কী আছে? ঘড়ি? আংটি?
আংটি নাই। আমি ঢোক গিলে বললাম, একটা ঘড়ি আছে।
দেখি।
আমি বালিশের তলা থেকে আমার ঘড়িটা বের করে দিলাম। ডিজিটাল ঘড়ি স্টেডিয়ামের সামনে ফুটপাত থেকে দশ টাকায় কিনেছিলাম। আরো ভালো করে দরদাম করলে মনে হয় আরো দুই টাকা কম রাখত। ঘড়িটা দেখে কাউলা খুব রেগে গেল, চিৎকার করে বলল, আপনি একজন ভদ্রলোক মানুষ এই ঘড়ি পরেন? রিকশাওয়ালারাও তো এইটা পরে না।