সায়রা পুরোটা এমনভাবে তৈরি করেছে যেন ব্যবহার করতে কোনো সমস্যা না হয়। পুরোটা সাউন্ড অ্যাকটিভেটেড অর্থাৎ শব্দ দিয়ে চালু করা যায়। আমাকে কোনো সুইচ টিপতে হবে না শুধু জোরে একবার হাততালি দিতে হবে। বন্ধ করার জন্য তিনবার, দু বার কাছাকাছি তৃতীয়বার একটু পরে। এখন মালিশ মেশিন চালু করার জন্য আমি হাত দুটোর। দিকে তাকিয়ে জোরে একবার হাততালি দিলাম।
সাথে সাথে হাত দুটো জীবন্ত হাতের মতো নড়ে উঠল। আমি নিশ্চিতভাবে জানি এটা যন্ত্রের হাত তারপরেও আমার কেমন জানি ভয়ে শরীর শিরশির করতে থাকে। হাত দুটো কেমন জানি গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে, তারপর আঙুলগুলো দিয়ে হাঁটতে থাকে, আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম, দেখলাম হাত দুটো মেঝেতে খামচে খামচে আমার পিছনে গিয়ে চেয়ার বেয়ে উঠতে লাগল। একটু পরে টের পেলাম দুটো হাত আমার ঘাড়ের দুই পাশে আঁকড়ে ধরেছে। আমি শক্ত হয়ে বসে রইলাম এবং টের পেলাম হাত দুটো খুব সাবধানে আমার ঘাড় মালিশ করতে শুরু করেছে। প্রথমে খুব আস্তে আস্তে তারপর একটু জোরে। হাত দুটো আমার ঘাড় থেকে দুই পাশে একটু নেমে গেল, গলায় হাত বুলিয়ে পিঠের দিকে মালিশ করে দিল। আস্তে আস্তে হাত নাড়িয়ে সেটা নিচে থেকে উপরে, উপর থেকে নিচে তারপর দুই পাশে সরে যেতে লাগল। খুব ধীরে ধীরে আমার শরীরটা শিথিল হয়ে আসে, এক ধরনের আরাম সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, আমার হাত-পা, ঘাড়, মাথা সবকিছু কেমন জানি অবশ হয়ে আসে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে থাকে এবং আমি আরামে আহ্ উহ্ করে একেবারে নেতিয়ে পড়তে থাকি। রাতে ঘুমানোর আগে মালিশ মেশিন সংক্রান্ত তথ্য নোটবইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখলাম।
১৪ই অক্টোবর রাত্রি দশটা তিরিশ মিনিট
অত্যন্ত কার্যকরী সেশান। অল্প কাতুকুতু অনুভব হয়।
তবে মেঝেতে খামচে খামচে আসার দৃশ্যটি ভীতিকর।
দুর্বল হার্টের মানুষের জন্য সুপারিশ করা গেল না।
মালিশের সাথে তৈল প্রদানের ব্যবস্থা করা যায়।
নিজের লেখাটি পড়ে আমি বেশ মুগ্ধ হয়ে গেলাম, কী সুন্দর গুছিয়ে লিখেছি, পড়লেই একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা গবেষণা ভাব আছে বলে মনে হয়।
মালিশ মেশিনের হাত দুটো কোথায় রাখা যায় ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, আজকের জন্য আপাতত খাটের নিচে রেখে দিলাম। মশারি টাঙিয়ে শুয়ে শুয়ে আমি মালিশ মেশিন নিয়ে কী কী করা যায় সেটা চিন্তা করতে করতে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকি। দেশের অবস্থা খারাপ, চোর-ডাকাতের উৎপাত খুব বেড়েছে। প্রতিদিনই খবর পাচ্ছি আশপাশে কারো বাসা থেকে কিছু না কিছু চুরি হচ্ছে। আমার বাসায় এমনিতেই কিছু নেই কিন্তু চোর এসে যদি মালিশ মেশিনের হাত দুটো চুরি করে নিয়ে যায় তা হলে আমি খুব বিপদে পড়ে যাব। কালকেই ভালো দেখে একটা লোহার ট্রাঙ্ক কিনে আনতে হবে–দেরি করা ঠিক হবে না।
আমি অবিশ্যি তখনো জানতাম না যে আসলে এর মাঝেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
.
এমনিতে আমার ঘুম খুব গভীর, বাসায় বোমা পড়লেও ঘুম ভাঙে না-কিন্তু ঠিক কী কারণ জানি না রাত্রিবেলা আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি শুয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম কেন হঠাৎ ঘুমটা ভেঙেছে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলাম না। তলপেটে একটু চাপ অনুভব করছিলাম, বাথরুমে গিয়ে সেই চাপটা কমিয়ে আসব কিনা চিন্তা করছিলাম কিন্তু বিছানা থেকে ওঠার ইচ্ছে করছিল না তাই আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ঠিক তখন মনে হল ঘরের ভেতর কয়েকজন মানুষ ঘোরাঘুরি করছে। আমি এই বাসায় একা থাকি আর কারো ঘোরাঘুরি করার কথা নয়। যারা ঘোরাঘুরি করছে তারা নিশ্চয়ই ভুল করে চলে আসে নি ইচ্ছে করেই এসেছে। ইচ্ছেটা যে খুব মহৎ না সেটাও বোঝা খুব সহজ। আমার জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে ঘুমের ভাব করে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা, মানুষগুলো যখন দেখবে এখানে নেয়ার মতো কিছু নেই তখন নিজেরাই যেদিক দিয়ে এসেছে সেদিক দিয়ে বের হয়ে যাবে। আমার শরীরের বিভিন্ন অংশ মনে হয় আমার ইচ্ছেমতো চলে না-নিজেদের একটা স্বাধীন মতামত আছে। এই মাত্র কিছুদিন আগে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার পা একটা কলার ছিলকের মাঝে পা দিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল। আজকেও তাই হল, আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম যে আমি বলে বসেছি কে?
ঘরের ভেতরে যারা ঘোরাঘুরি করছিল তারা যে যেখানে ছিল সেখানে থেমে গেল। শুনলাম একজন বলল, কাউলা, মক্কেল তো ঘুম থেকে উঠছে মনে লয়।
কাউলা নামের মানুষটা বলল, ঠিকই কইছেন ওস্তাদ। গুলি করমু?
অন্ধকারে করিস না। মিস করলে গুলি নষ্ট হইব। গুলির কত দাম জানস না হারামজাদা?
অন্ধকারে গুলি করে পাছে গুলি নষ্ট হয়ে যায় সেই ভয়ে ঘরের ভেতরের মানুষগুলো লাইট জ্বালাল। আমি দেখলাম দুইজন মানুষ, একজন কুচকুচে কালো। মনে হয়, সেইজন্যই নাম কাউলা। অন্যজন শুকনো এবং দুবলা, নাকের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ, ঠিক কী কারণ।
জানি না, মাথার মাঝে একটা বেসবল ক্যাপ। দুইজনেই হাফপ্যান্ট পরে আছে হাফপ্যান্টের নিচে শুকনো শুকনো পাগুলো কেমন যেন বিতিকিচ্ছি হয়ে বের হয়ে আছে। কাউলার পরনে একটা লাল গেঞ্জি। ওস্তাদ একটা সবুজ রঙের টি-শার্ট পরে আছে, টি-শার্টে মাইকেল জ্যাকসনের ছবি। কাউলার হাতে একটা বন্দুকের মতো অস্ত্র মনে হয় এইটাকে কাটা রাইফেল বলে। ওস্তাদের হাতে একটা পিস্তল। হঠাৎ আলো জ্বালানোতে সবার চোখই একটু ধাঁধিয়ে গেছে। ওস্তাদ তার মাঝে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে মশারির কাছে এগিয়ে এসে আমাকে দেখার চেষ্টা করল, আমাকে দেখে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কাউলা?