হায়ার হারমনিক্স কী, সেটা না থাকলে কেন মিথ্যা কথা বলা হয় না এই সব নিয়ে অনেক প্রশ্ন করা যেত কিন্তু আমার আর তার সাহস হল না। মানিব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে দিলাম। স্কুটারের ড্রাইভার উদাস উদাস ভাব করে বলল, ভাংতি নাই স্যার-ভাংতি দেন।
আমি কী বলতে কী বলে ফেলব আর এই আজব যন্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা সেখান থেকে কী বের করে ফেলবে সেই ভয়ে আমি হাত নেড়ে বললাম, ঠিক আছে পুরোটাই রেখে দেন।
ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, পুরোটাই রেখে দেব?
হ্যাঁ।
স্কুটার ড্রাইভার মুখে খুব অনিচ্ছার একটা ভঙ্গি করে টাকাটা পকেটে রেখে বলল, আপনি যখন বলছেনই তখন আর কী করা স্যার, রাখতেই হবে। আমি কিন্তু এমনিতে কখনোই এক পয়সা বেশি রাখি না। যত ভাড়া তার থেকে এক পয়সা বেশি নেওয়া হচ্ছে হারাম খাওয়া। হারাম খাওয়া ঠিক না হারাম খাওয়ার পর সেই হারাম রুজি দিয়ে শরীরের যে অংশে রক্ত-মাংস তৈরি হয় সেই অংশ দোজখের আগুনে পোড়ে শিক-কাবাবের মতো।
স্কুটার ড্রাইভার দোজখের আগুনের বর্ণনা দিতে দিতে তার স্কুটার স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় নেমে গেল। ক্যালকুলেটর এবং মোবাইল ফোনের মতো দেখতে যন্ত্রটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি তার যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, এই যে হায়ার হারমনিক্স আসছে। তার মানে এই ব্যাটা মিথ্যা কথা বলেছে! স্কুটারওয়ালা-এই স্কুটারওয়ালা
কিন্তু ততক্ষণে স্কুটার ড্রাইভার তার স্কুটার নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। মেয়েটা রাগ রাগ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখছেন ব্যাটা ধড়িবাজের কাজটা? ডাটা প্রসেস করতে একটু সময় নেয় তার মাঝে হাওয়া হয়ে গেল। ব্যাটা ফাজিল-
আমি হাত নেড়ে বললাম, যাক। পাঁচ টাকাই তো
মেয়েটা হাত ঝাঁকিয়ে বলল, মিথ্যা কথা বলে পাঁচ টাকা কেন পাঁচ পয়সাও নিতে পারবে না।
আমি একটু ভয়ে ভয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম, রাগী মহিলাদের আমি খুব ভয় পাই। বিশেষ করে রাগী নারীবাদী মহিলারা খুব ডেঞ্জারাস হয়। ছাত্রজীবনে আমাদের সাথে ডালিয়া নামে একটা মেয়ে পড়ত, তাকে একবার ঢ্যালঢ্যালা ডালিয়া ডেকেছিলাম, সেটা শুনে তার নারীবাদী বান্ধবী আমাকে দেওয়ালে চেপে ধরে পেটে ঘুসি মেরেছিল। ঘুসি খেয়ে বেশি ব্যথা পাই নি কিন্তু পুরো প্রেস্টিজ ধসে গিয়েছিল। মেয়েদের হাতে মার খায় মানুষটা দেখতে কেমন তা দেখার জন্য আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে ছাত্রছাত্রীরা চলে আসত।
মেয়েটা তার যন্ত্রটির দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল- আমি চলে যাব না থাকব বুঝতে পারলাম না। কিছু একটা বলার দরকার কিন্তু কী বলব সেটাও বুঝতে পারলাম না। মানুষের সাথে মোটামুটি আমি কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারি কিন্তু মেয়েদের বেলায় খুব সমস্যা হয়। অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলার জন্য তার বয়সটা জানলে খুব সুবিধা হয় কিন্তু মেয়েদের বয়স আন্দাজ করা খুব কঠিন। একবার একটা পার্টিতে একটা মেয়ের থুতনি ধরে আদর করে বলেছিলাম, খুকি তুমি কোন ক্লাসে পড়? মেয়েটা ঝটকা মেরে আমার হাত সরিয়ে বলেছিল, ফাজলেমি করেন? আমি ইউনিভার্সিটির টিচার। শুনে আমার একেবারে হার্টফেল করার অবস্থা। একেবারে দুধের শিশুদের ইউনিভার্সিটির টিচার বানালে সেই ইউনিভার্সিটিতে কি পড়াশোনা হতে পারে? আরেকবার এক বাসায় গিয়ে মোটাসোটা এক ভদ্রমহিলাকে বললাম, আন্টি, আংকেল কি বাসায় আছেন? সেই ভদ্রমহিলা ভ্যা করে কেঁদে দিল, বলল, এ্যা এ্যা-আমি মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ি-আমাকে এই মানুষটা আন্টি ডাকে! এ্যা এ্যা এ্যা- সেই থেকে আমি কখনোই কোনো মেয়ের বয়স আন্দাজ করে বের করার চেষ্টা করি না। এখানেও এই মহিলার কিংবা মেয়ের বয়স কত অনুমান করার কোনো চেষ্টা না করে, শুধুমাত্র আলাপ চালানোর জন্য বললাম, খুব মজার যন্ত্র। তাই না?
মেয়েটা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হুঁ।
আমি গলার স্বরে একটা দার্শনিকতার ভাব এনে বললাম, বিজ্ঞানের কত উন্নতি হয়েছে-একটা যন্ত্র দিয়ে মনের অনুভূতি বের করে ফেলা যায়। কী আশ্চর্য!
মেয়েটা আবার বলল, হুঁ।
বিদেশ থেকে এনেছেন বুঝি যন্ত্রটা? কত খরচ পড়েছে?
মেয়েটা আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল, তারপর বুকে থাবা দিয়ে বলল, এইটা আমি তৈরি করেছি।
আমি চমকে উঠলাম, বলে কী মেয়েটা! আবার ভালো করে তাকালাম মেয়েটার দিকে, আমার সাথে ঠাট্টা করছে নাকি? মেয়েটার চোখে-মুখে অবিশ্যি ঠাট্টার কোনো চিহ্ন নেই- বলা যেতে পারে এক ধরনের রাগের চিহ্ন আছে। আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, কী হল? আমার কথা বিশ্বাস হল না?
আমি তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললাম, না-না বিশ্বাস হবে না কেন? অবশ্যই বিশ্বাস হয়েছে।
তা হলে এরকম চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছেন কেন?
চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছি নাকি? আমি চোখগুলো ছোট করার চেষ্টা করে এমন একটা ভান করার চেষ্টা করতে লাগলাম যেন রাস্তাঘাটে এরকম খ্যাপা টাইপের একটা মেয়ে যে নাকি ভয়ংকর যন্ত্রপাতি তৈরি করে তার সাথে দেখা হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
মেয়েটা বলল, হ্যাঁ, আপনি চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছেন। আপনি মনে মনে কী ভাবছেন সেটাও আমি জানি।