কিন্তু মালিশ করার জন্য অন্য মানুষকে ভাড়া করা জিনিসটা কেমন দেখায়?
সায়রা মাথা নাড়ল, একেবারেই ভালো দেখায় না।
কাজেই এরকম আরামের একটা জিনিস কিন্তু কখনোই পাওয়া যাবে না।
আপনি ঠিকই বলেছেন। একজনু মানুষ খালি গায়ে বসে আছে আরেকজন তাকে তেল মাখিয়ে দলাইমলাই করছে ব্যাপারটা খুবই কুৎসিত। কিন্তু
কিন্তু কী?
সায়রা হঠাৎ করে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। একবার সে অন্যমনস্ক হয়ে গেলে হঠাৎ করে কথাবার্তা বন্ধ করে দেয়। দশটা প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেয়, সেই উত্তরও হয় দায়সারা কাজেই আমি আর সময় নষ্ট না করে সায়রার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
.
মাসখানেক পরে হঠাৎ একদিন আমি সায়রার ই-মেইল পেলাম। বরাবরের মতো ছোট ই-মেইল, সেখানে লেখা :
জরুরি। দেখা করুন।
আমি সেদিন বিকালবেলাতেই সায়রার বাসায় হাজির হলাম। সায়রার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে, নতুন কিছু আবিষ্কার করলে তার মুখে এরকম আনন্দের ছাপ পড়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, নতুন কিছু আবিষ্কার করেছেন নাকি?
বলতে পারেন করেছি।
কী জিনিস?
আপনাকে দেখাব, ধৈর্য ধরেন। তার আগে অন্য একটা জিনিস দেখাই।
কী?
সায়রা তার শেলফের দিকে দেখিয়ে বলল, এই দেখেন। আমি তাকিয়ে দেখি তার শেলফ বোঝাই মালিশের বই। মাথা মালিশ, ঘাড় মালিশ, পেট মালিশ, পিঠ মালিশ থেকে শুরু করে চোখের ভুরু মালিশ, চোখের পাতি মালিশ এমনকি কানের লতি মালিশ পর্যন্ত আছে! সেই মালিশের কায়দাকানুন এসেছে সারা পৃথিবী থেকে ভারতীয় আয়ুর্বেদীয় মালিশ থেকে শুরু করে চীন-জাপান-কোরিয়ান মালিশ, আমেরিকান পাওয়ার মালিশ, মেক্সিকান ঝাল মালিশ, আফ্রিকান গরম মালিশ, এমনকি একেবারে এস্কিমো ঠাণ্ডা মালিশও আছে। শুধু যে বই তাই নয়, ভিডিও, সিডি, কাগজের বান্ডিল সবকিছুতে বোঝাই। আমি অবাক হয়ে বললাম, করেছেন কী? পৃথিবীর সব মালিশের বই সিডি ক্যাসেট নিয়ে এসেছেন মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ।
কেন?
ব্যাপারটা একটু স্টাডি করে দেখলাম।
কী দেখলেন?
আপনি এই চেয়ারটায় বসেন, আমি দেখাই।
এর আগেও সায়রার কথা শুনে এরকম চেয়ারে বসে বড় বড় বিপদে পড়েছি। ভয়ে ভয়ে বললাম, কোনো বিপদ হবে না তো?
না। কোনো বিপদ হবে না।
আমি সাবধানে চেয়ারে বসলাম। সায়রা বলল, চোখ বন্ধ করেন।
যে ব্যাপারটাই ঘটুক-চাইছিলাম চোখের সামনেই সেটা হোক, কিন্তু সায়রার কথা শুনে চোখ বন্ধ করতে হল। সায়রা পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, আমি খুব সাবধানে আপনার ঘাড় স্পর্শ করছি।
টের পেলাম সায়রা আমার দুই ঘাড় স্পর্শ করল। এবারে হালকাভাবে মালিশ করে দিচ্ছি-এটি হচ্ছে কোরিয়ান মালিশ।
আমি চোখ বন্ধ করে টের পেলাম খুব দক্ষ মানুষের মতো সায়রা আমার ঘাড় মালিশ করতে শুরু করেছে। সায়রার মতো এরকম একজন ভদ্রমহিলা আমার ঘাড় মালিশ করে দিচ্ছে চিন্তা করে আমার একটু অস্বস্তি হতে লাগল কিন্তু সে এমন এক্সপার্টের মতো হাত চালিয়ে যাচ্ছে যে আরামে আমার শরীর অবশ হয়ে এল।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর আমি বললাম, এখন চোখ খুলতে পারি?
সায়রা বলল, খোলেন।
আমি চমকে উঠলাম, সায়রা আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ঘাড় মালিশ করে দিচ্ছে কিন্তু উত্তরটা আসলো সামনে থেকে। আমি চোখ খুলে একেবারে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম, সায়রা সামনে একটা চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে! অন্য কেউ আমার ঘাড় মালিশ করছে।
আমি পেছনে তাকালাম, কেউ নেই। ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখি দুটো হাত ঘাড়ের মাংসপেশি ডলে দিচ্ছে। একটু ভালো করে তাকালাম, সত্যিকারের হাত কোনো সন্দেহ। নেই-কিন্তু সেটা কনুইয়ের কাছে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। আতঙ্কে চিৎকার করে আমি হাত দুটি ধরে ছুঁড়ে দেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সেগুলো প্রচণ্ড শক্তিশালী, আমার ঘাড় কিছুতেই ছাড়বে না। আমি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে সারা ঘরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলাম, পায়ের সাথে ধাক্কা লেগে একটা টেবিল ল্যাম্প, দুইটা ফুলদানি, বইয়ের শেলফ উন্টে পড়ল। আমি লাফিয়ে উঁদিয়ে গড়াগড়ি দিয়ে সেই ভয়ংকর ভৌতিক দুটো হাত থেকে ছাড়া পাবার চেষ্টা করতে লাগলাম-কিন্তু কিছুতেই ছাড়া পেলাম না। আমার লাফঝাঁপ দেখে সায়রা ভয় পেয়ে কোথায় জানি ছুটে গিয়ে একটা সুইচ টিপ দিতেই হঠাৎ করে হাত দুটো আমাকে ছেড়ে দিয়ে কেমন যেন নেতিয়ে পড়ল। আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দুই লাফে সরে গিয়ে ভয়ে ভয়ে সেই কাটা হাত দুটোর দিকে তাকালাম, এখনো প্রচণ্ড আতঙ্কে আমার বুকের ভেতরে ধকধক শব্দ করছে।
সমস্ত ঘরের একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা, এর মাঝে সায়রা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটু শান্ত হবার পর সায়রা জিজ্ঞেস করল, আপনি-আপনি কী করছেন?
আমি হাত দুটো দেখিয়ে বললাম, এগুলো কার কাটা হাত?
সায়রা হেঁটে গিয়ে হাত দুটো তুলে বলল, কাটা হাত? কাটা হাত কেন হবে? এটা পলিমারের হাত। ভেতরে মাইক্রো প্রসেসর কন্ট্রোলড যন্ত্রপাতি আছে।
আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না, বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বললাম, তার মানে এইগুলো সত্যিকারের হাত না?
সায়রা চোখ কপালে তুলে বলল, আপনি সত্যিই মনে করেন আমি মানুষের হাত কেটে বাসায় নিয়ে আসব?
না, মানে ইয়ে- আমি আমতা-আমতা করে বললাম, আমি ভেবেছিলাম ভৌতিক কিছু।