সায়রা মাথা নেড়ে বলল, আপনি ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। আমি বলছি আকার আর সাইজের দিক থেকে! মনে করেন আপনি পুরো ফ্রিজ রসগোল্লা আর সন্দেশ দিয়ে ভরে ফেলতে চান। কোনটা বেশি রাখতে পারবেন?
আমি আবার মাথা চুলকালাম, এক ফ্রিজ বোঝাই শুধু রসগোল্লা কিংবা শুধু সন্দেশ চিন্তা করেই আমার গা গুলিয়ে যায়। কী উত্তর দেব বুঝতে পারছিলাম না, সায়রা বক্তৃতা দেওয়ার মতো করে বলল, সন্দেশ! কেন জানেন?
কেন?
কারণ সন্দেশ হচ্ছে কিউব, তাই সন্দেশ গায়ে গায়ে লেগে থাকতে পারে-কোনো জায়গা নষ্ট হয় না। কিন্তু রসগোল্লা হচ্ছে গোলক, এগুলো রাখলে তার মাঝে ফাঁকা জায়গা থাকে।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম কিন্তু এত জিনিস থাকতে সায়রা কেন এই জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে বুঝতে পারলাম না। আমার মুখ দেখে মনে হয় সায়রা সেটা টের পেল, জিজ্ঞেস করল, কেন আমি এটা বলছি বুঝতে পারছেন?
না।
খুব সহজ। সায়রা মাথা নেড়ে বলল, মনে করেন ডিমের কথা। ডিম যদি ডিমের মতো না হয়ে চারকোনা কিউবের মতো হত তা হলে কী হত?
ডিম পাড়তে মুরগিদের খুব কষ্ট হত।
না-না সেটা বলছি না!
তা হলে কোনটা বলছেন?
ডিম স্টোর করা কত সহজ হত চিন্তা করতে পারেন? একটার ওপর আরেকটা রেখে দেওয়া যেত। সেরকম তরমুজ যদি চারকোনা হত তা হলে অল্প জায়গায় অনেক বেশি তরমুজ রাখা যেত। আলু-টম্যাটো যদি চারকোনা হত–অল্প জায়গায় অনেক বেশি জিনিস রাখা যেত।
আমি চতুষ্কোণ কিউবের মতন ডিম, আলু, তরমুজ কিংবা টম্যাটো চিন্তা করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কাজটা কেন জানি সহজ হল না, উল্টো আমার শরীর কেমন জানি শিরশির করতে লাগল। সায়রা সেটা লক্ষ করল না, মুখ শক্ত করে বলল, আমি ঠিক করেছি যত ফলমূল আছে সবকিছু চতুষ্কোণ কিউবের মতো বানিয়ে ফেলব।
সব?
হ্যাঁ। লাউ কুমড়া পটল ঝিঙে থেকে শুরু করে আলু টম্যাটো ডিম কিছুই বাকি রাখব। গরিব দেশে কোল্ড স্টোরেজে এসব রাখতে কত জায়গা নষ্ট হয়-একবার কিউব বানিয়ে ফেললে আর কোনো জায়গা নষ্ট হবে না। কী বলেন আপনি?
আমি মাথা চুলকালাম-উদ্দেশ্য অতি মহৎ তাই বলে চারকোনা কিউবের মতো লাউ? কুমড়া? পটল? ডিম? সবকিছুই যদি চারকোনা হয়ে যায় তখন কী হবে? গাড়ির চাকা চারকোনা, চোখের মণি চারকোনা-ফুটবল চারকোনা-আকাশের চাঁদ চারকোনা-চিন্তা করেই আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। আমার জন্য শেষ পর্যন্ত সায়রার মনে হয় একটু মায়াই হল, বলল, আপনি আসার পর থেকেই শুধু আমিই বকবক করে যাচ্ছি। এবারে আপনার কী খবর বলেন?
আমি বললাম, ভালো। তবে-
তবে কী?
খুব ভালো ছিলাম না।
কেন?
আমি তখন কলার ছিলকে আর মুগরির রোস্টের কাহিনী শুনালাম। সায়রা মোটামুটি ভদ্র মেয়ে অন্যদের মতো হেসে গড়িয়ে পড়ল না। গল্প শেষ করে আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেই ঘটনার পর আপনার কাছে একটা প্রশ্ন
কী প্রশ্ন?
মালিশ করলে খুব আরাম লাগে, কিন্তু নিজে নিজে মালিশ করলে এত আরাম লাগে, ব্যাপারটা কী?
আমার প্রশ্ন শুনে সায়রা ফিক করে একটু হেসে ফেলল, বলল, কঠিন প্রশ্ন করে ফেলেছেন! সত্যিই তো তাই! সে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, মালিশ করলে সেখানে ব্লাড সার্কুলেশন বেড়ে যায়, নার্ভ দিয়ে একটা স্টিমুলেশন যায় সেজন্য ভালো লাগে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আপনাকে ব্যাপারটা একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাই।
কী এক্সপেরিমেন্ট?
এই দেওয়ালে একটা ঘুসি মারেন দেখি।
দেওয়ালে ঘুসি মারব? ব্যথা লাগবে না?
না ব্যথা লাগবে না–আমি ব্যথা না লাগার একটা স্পেশাল ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি। সায়রা উঠে গিয়ে পানির মতো কী একটু ওষুধ এনে আমার হাতের আঙুলে লাগিয়ে দিল। বলল, মারুন ঘুসি।
আমি দেওয়ালে ঘুসি মেরে বাবাগো বলে হাত চেপে বসে পড়লাম, মনে হল সবগুলো আঙুল ভেঙে গেছে। বাম হাত দিয়ে ডান হাতের ব্যথা পাওয়া জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাঙা গলায় বললাম, আপনার ওষুধ কাজ করল না দেখি! ভয়ংকর ব্যথা লেগেছে।
এইটা ওষুধ ছিল না। এইটা ছিল পানি।
তা হলে?
ইচ্ছে করে বলেছিলাম যেন আপনি একটু ব্যথা পান।
কেন? আমি কী করেছি? আমাকে ব্যথা দিচ্ছেন কেন?
আপনি একটা এক্সপেরিমেন্ট করছেন।
আমি এক্সপেরিমেন্ট করছি? কখন?
সায়রা হাসি হাসি মুখে বলল, এই যে আপনি যেখানে ব্যথা পেয়েছেন সেখানে হাত বুলাচ্ছেন। এটা একটা এক্সপেরিমেন্ট।
কীভাবে?
মানুষ যখন ব্যথা পায় তখন ব্যথার অনুভূতিটা নার্ভের ভেতর দিয়ে ব্রেনে যায়, তখন ব্যথা লাগে। যখন আপনি ব্যথা পাওয়া জায়গায় হাত বুলাতে থাকেন তখন ব্যথার সাথে স্পর্শের অনুভূতিটাও পাঠাতে হয়। আপনার নার্ভ তখন কিছু সময় পাঠায় ব্যথার অনুভূতি অন্য সময় পাঠায় স্পর্শের অনুভূতি-যেহেতু ব্যথার অনুভূতিটা স্পর্শের অনুভূতির সাথে ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে তাই সেটা কমে যায়। বুঝেছেন?
আমি মাথা নাড়লাম, বুঝেছি। সায়রার কথা বিশ্বাস করে মনে হয় একটু বেশ জোরেই ঘুসি মেরেছিলাম। ভাগাভাগি করার পরও হাতটা ব্যথায় টনটন করছে।
কাজেই যখন নিজে মালিশ করেন তখন মালিশের যে আরামের অনুভূতি-সেটা মালিশ করার সাথে ভাগাভাগি করে হয়-আমার মনে হয় সেটা একটা কারণ হতে পারে- যে কারণে অন্য কেউ মালিশ করলে পুরো আরামের অনুভূতিটা পাওয়া যায়।