বুয়া প্রায় সাথে সাথে ছুটে এল, আমারে ডাকছেন আম্মা?
বোন তেলের বাটিটা দেখিয়ে বললেন, এইখানে কী দিয়েছ?
সর্ষের তেল শেষ। মুরগি রোস্টের থেকে চিপে ঘি বের করে গরম করে দিয়েছি আম্মা!
এক মুহূর্তে আমার স্বর্গীয় আনন্দ উবে গেল, সমস্ত ব্যথা ভুলে আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বললাম, কী বললে তুমি? কী বললে? মুরগি রোস্টের ঘি?
বুয়া অবাক হয়ে বলল, এত রাগ হন কেন মামা? ঘি কি খারাপ জিনিস?
আমি চিৎকার করে বললাম, রসগোল্লাও তো ভালো জিনিস তাই বলে তুমি শরীরে রসগোল্লা মেখে বসে থাকবে?
বুয়া অবাক হয়ে বলল, মামা, এইসব কী কয়? মানুষ শরীলে রসগুল্লা মাখবে কেন? মামার কি মাথা খারাপ হইছে?
আমার ইচ্ছে হল বুয়ার গলা টিপে তাকে খুন করে ফেলি, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম। বোন খানিকক্ষণ চোখ লাল করে বুয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে হি হি করে হেসে ফেলল, কিছুতেই আর হাসি থামাতে পারে না। তার হাসি শুনে দুলাভাই আর বিল্টু ছুটে এল, জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
বোন আমাকে দেখিয়ে বলল, শুঁকে দেখ।
দুলাভাই আর বিল্টু সাবধানে আমাকে শুঁকে দেখল। বিল্টু ভুরু কুঁচকে বলল, মামা তোমার শরীর থেকে চিকেন রোস্টের গন্ধ বের হচ্ছে কেন?
দুলাভাই বললেন, নতুন ধরনের কোনো আফটার শেভ?
বুয়া ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করল, জে না। মামা শরীরে মুরগির রোস্টের ঘি মাখছে
দুলাভাই চোখ কপালে তুলে বলল, সে কী? এরকম কাজ করলে কেন?
আমি মেঘস্বরে বললাম, আমি করি নাই।
তা হলে কে করেছে?
আপা।
দুলাভাই বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা কোন ধরনের রসিকতা? দশটা নয় পাঁচটা নয় আমার একটা মাত্র শালা তাকে তুমি ঘি মাখিয়ে রাখছ? মানুষটা সাদাসিধে বলে সবাই মিলে কেন বেচারাকে উৎপাত কর?
বোন মাথা নাড়ল, হাসির দমকে কথা বলতে পারছে না, কোনোমতে বলল, আমি ইচ্ছা করে করি নাই–এই বুয়া।
সবাই মিলে হাসাহাসি করছে দেখে বুয়াও হঠাৎ করে খুব উৎসাহ পেয়ে গেল, সেও হাসতে হাসতে বলল, গোন্ধটা খারাপ না। এখন আপনাকে দেখলে মনে হয় একটা কামড় দেই। হি হি হি
আমার ঘাড়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, বাম পা-টা টনটন করছে, কপালের কাছে খানিকটা ফুলে গেছে এবং সেই অবস্থায় ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আমি চলে এলাম, ঠিক করলাম যতদিন এই বুয়া বাসায় আছে আমি আর সেই বাসায় যাচ্ছি না।
পরের এক সপ্তাহ আমার শরীর থেকে মুরগির রোস্টের গন্ধ বের হতে লাগল। যার সাথেই দেখা হয় সেই বলে, চিকেন রোস্ট আপনার খুব ফেবারিট? আচ্ছামতন খেয়েছেন। মনে হচ্ছে-শরীর থেকে গন্ধ বের হচ্ছে।
.
সপ্তাহ দুয়েক পর ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলাম রাতে নিশ্চয়ই বেকায়দায় ঘুমিয়েছি, ঘাড়ে ব্যথা। এর আগের বার বোন মালিশ করে দিয়েছিল–ভারি আরাম লেগেছিল সেদিন, আমি তাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ঘাড় মালিশ করতে শুরু করলাম। একটু পরেই আবিষ্কার করলাম আজকে সেরকম আরাম লাগছে না। অন্যে মালিশ করে দিলে যেরকম আরামে একেবারে চোখ বন্ধ হয়ে আসে নিজে মালিশ করলে তার ধারেকাছে যাওয়া যায় না। কারণটা কী? এর নিশ্চয়ই একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। অনেক দিন সায়রা সায়েন্টিস্টের বাসায় যাওয়া হয় নি একবার গিয়ে জিজ্ঞেস করে এলে হয়। যারা খেতে পছন্দ করে তাদের বাসায় দইয়ের হাড়ি নিয়ে যেতে হয়, যে কবি তার বাসায় যেতে হয়। কবিতার বই নিয়ে। যে গান গায় সে নিশ্চয়ই খুশি হয় গানের সিডি পেলে, যে বিজ্ঞানী তার কাছে নিশ্চয়ই বৈজ্ঞানিক সমস্যা নিয়েই যাওয়া উচিত। পরদিন বিকেলবেলা আমি সায়রা। সায়েন্টিস্টের বাসায় হাজির হলাম। আমাকে দেখে সায়রা বললেন, ভালোই হয়েছে আপনি এসেছেন। মনে মনে আমি আপনাকেই খুঁজছি।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? আবার কোনো এক্সপেরিমেন্ট?
না, এক্সপেরিমেন্ট না। একটা মতামত জানার জন্য আপনার খোঁজ করছিলাম।
সায়রার কথা শুনে গর্বে আমার বুকটা কয়েক ইঞ্চি ফুলে গেল, আমার পরিচিতদের কেউই আমাকে খুব সিরিয়াসলি নেয় না। কখনো কেউ আমার মতামত জানতে চেয়েছে। বলে মনে পড়ে না। অথচ সায়রা এত বড় বিজ্ঞানী হয়ে আমার মতামত জানতে চাইছে। আমি মুখে এটা গাম্ভীর্য এনে জিজ্ঞেস করলাম, কোন বিষয়ে মতামত?
রসগোল্লা না সন্দেশ, কোনটা আপনার পছন্দ?
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম, ভেবেছিলাম সায়রা বুঝি দেশ, সমাজ, রাজনীতি, ফিলসফি এরকম কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে! অবিশ্যি একদিক দিয়ে ভালোই হল জটিল কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়া কঠিন হয়ে যেত-সেই হিসেবে এই প্রশ্নটাই ভালো। আমি বললাম, আমার ব্যক্তিগত পছন্দ রসগোল্লা
কেন?
জিনিসটা রসালো, নরম, মিষ্টি বেশি।
না, না, না- সায়রা আমাকে থামিয়ে দিয়ে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, আমি স্বাদের কথা বলছি না।
আমি থতমত খেয়ে বললাম, তা হলে?
আকারের কথা বলছিলাম।
আকার?
হ্যাঁ। সায়রা গম্ভীর মুখে বলল, একটা হচ্ছে গোল, আরেকটা চতুষ্কোণ। কোনটা সঠিক?
আমি মাথা চুলকাতে শুরু করলাম। রসগোল্লা আর সন্দেশের আকারে যে সঠিক আর বেঠিক আছে কে জানত? আমতা-আমতা করে বললাম, ইয়ে-দুইটা দুই রকম। মনে করেন রসগোল্লা যদি চারকোনা হত তা হলে কি সেটাকে রসগোল্লা বলা যেত? বলতে হত রসকিউব। কিন্তু যেমন কেউ ভয় পেলে আমরা বলি চোখ রসগোল্লার মতো বড় হয়েছে-যদি রসগোল্লা না থেকে শুধু রসকিউব থাকত তা হলে আমরা কি সেটা বলতে পারতাম?