কাজেই আমি খুব সাবধানে কলার ছিলকে বাঁচিয়ে সিঁড়িতে পা ফেললাম; আর কী আশ্চর্য ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে ঘটল সেটা এখনো একটা রহস্যের মতো; আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি ঠিক ছিলকেটার ওপর পা ফেলেছি। তারপর ঠিক আমি যা ভেবেছিলাম তাই ঘটল, আমি প্রথমে পা পিছলে দড়াম করে পড়ে গেলাম, তারপর গাছের গুঁড়ির মতো গড়িয়ে যেতে লাগলাম। প্রায় অনন্তকাল গড়িয়ে আমি সিঁড়ির নিচে পৌঁছে দেওয়ালটাকে আঘাত করলাম, আমার হাত ভাঙল, পা ভাঙল, মাথা ফেটে রক্তারক্তি হয়ে গেল, মাথার ভেতরে ঘিলু নড়ে উঠে ব্রেন ড্যামেজ হয়ে গেল এবং আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। কে জানে হয়তো শুধু অজ্ঞান নয়, মরেই গেলাম।
আমার ওজন নেহায়েৎ কম নয় দেখলে মন খারাপ হয় বলে আজকাল অবিশ্যি ওজন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি), কলার ছিলকেতে পা পিছলে আমি নিশ্চয়ই ভীষণ শব্দ করে পড়েছি, দেওয়ালে মাথা ঠুকে যাবার সময় নিশ্চয়ই একটা গগনবিদারী চিৎকারও করেছিলাম-কারণ দেখতে পেলাম দরজা খুলে আমার বোন, দুলাভাই, বি এবং কাজের বুয়া ছুটে এসেছে। বিন্দু ছোট বলে সে সবার আগে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল, মামা, তুমি এখানে শুয়ে আছ কেন?
সবাইকে যখন দেখতে পাচ্ছি, কথা শুনতে পাচ্ছি তার মানে নিশ্চয়ই মরে যাই নি বা অজ্ঞানও হয়ে যাই নি। কথা যেহেতু বুঝতে পারছি মনে হয় এখনো পুরোপুরি ব্রেন ড্যামেজ হয় নি। আমি কোকাতে কোকাতে বললাম, পিছলে পড়ে গিয়েছি।
বিল্টু কলার ছিলকেটা আবিষ্কার করে বলল, তুমি হাঁটার সময় কি চোখগুলো খুলে পকেটের মাঝে রেখে দাও? কলার ছিলকেটা দেখ নি?
ফাজলেমি করবি না বি-দেখছিস না হাত-পা সব ভেঙে গেছে? মাথা ফেটে গেছে?
তোমার কিছু হয় নি মামা, ওঠ।
ততক্ষণে বোন, দুলাভাই এবং বুয়াও চলে এসেছে। বুয়া বলল, না বিল্টু বাই, মামার অবস্থা কেরাসিন। মনে হয় হাত-পা ভাইঙ্গা লুলা হইয়া গেছে।
দুলাভাই এসে আমাকে টিপেটুপে দেখে বলল, তুমি পড়েছ খুব জোরে, কিন্তু কিছু ভাঙে টাঙে নাই।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
উঠতে পারবে? নাকি ধরে নিতে হবে।
বুয়া শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে এগিয়ে এসে বলল, মামারে আমার কোলে তুইল্যা দেন আমি উপরে নিয়া যাই। আমি নিজে নিজে উপরে উঠতে পারব ভরসা ছিল না, কিন্তু টিঙটিঙে বুয়া যেভাবে আমাকে কোলে করে উপরে নিয়ে যেতে হাজির হল যে আমি তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে গেলাম। এক হাত দুলাভাইয়ের উপর আরেক হাত বিল্টুর ঘাড়ে দিয়ে। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে উপরে উঠে এলাম। দুলাভাইয়ের কথা সত্যি হাত-পা কিছু ভাঙে নি, মাথাও ফাটে নি। খুব বেঁচে গেছি এই যাত্রা।
আমাকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে দুলাভাই বললেন, তোমাকে আরো সাবধান হতে হবে। যেখানেই যাও সেখানেই যদি এইভাবে আছাড় খাও তা হলে ঢাকা শহরের সব বিল্ডিং ধসিয়ে ফেলবে।
বোন এক গ্লাস পানি এনে বললেন, খা তাড়াতাড়ি।
কী এটা?
লবণ পানি। পড়ে গিয়ে শক পেলে খেতে হয়।
এটা কোন দেশী চিকিৎসা জানি না কিন্তু বোনের কথা না শুনে উপায় নেই। তাই পুরোটা খেতে হল। বোন বললেন, সর্ষে দিয়ে ইলিশ বেঁধেছিলাম। কিন্তু তোর যা অবস্থা, তুই তো খেতেও পারবি না।
আমি হালকাভাবে আপত্তি করে কিছু একটা বলতে চাইছিলাম কিন্তু বুয়া চিৎকার করে বলল, কী কন আম্মা আপনি খাওয়ার কথা? মামা এখন খাইলে উপায় আছে? শরীরের বিষ নাইম্যা যাইব না? সর্বনাশ!
কাজেই শরীরে যেন বিষ নেমে না যায় সেজন্য আমি সোফায় উপুড় হয়ে শুয়ে রইলাম, অন্যেরা যখন হইচই করে সর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছ খেল তখন আমি খেলাম আধবাটি বার্লি।
কিছুক্ষণ পর বোন এসে জিজ্ঞেস করল, তোর শরীরের অবস্থা কী?
আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, এখন মনে হয় ভালো। তবে ঘাড়ে খুব ব্যথা। কোথায়?
আমি হাত দিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিলাম। বোন বলল, দে একটু মালিশ করে দিই। ভালো লাগবে।
আমি বললাম, না, না, লাগবে না
বোন আমার কথা শুনল না, মাথার কাছে বসে আমার ঘাড় মালিশ করতে লাগল। প্রথমে এক-দুইবার ব্যথার একটা খোঁচা অনুভব করলাম, তারপর কিন্তু বেশ আরামই লাগতে লাগল। আমি চোখ বুজে আরামে আহা-উঁহু করতে লাগলাম। বোন বলল, পঁড়া একটু সর্ষের তেল দিয়ে নিই, দেখবি ব্যথা কোথায় পালাবে।
ঘাড় মালিশ করতে করতে বোন বুয়াকে ডেকে খানিকটা সর্ষের তেল গরম করে দিয়ে যেতে বলল। বুয়া একটু পরেই গরম তেল দিয়ে গেল, সেটা হাতে নিয়ে বেশ কায়দা করে ঘাড়ে তেল মালিশ করে দিতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি বাংলা ভাষায় তেল মালিশ বলে যে একটা শব্দ আছে সেটা কোথা থেকে এসেছে কেমন করে এসেছে এই প্রথমবার আমি সেটা বুঝতে পারলাম। ঘাড় থেকে আরামটা আমার সারা শরীরে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আমার চোখ বুজে এল এবং মনে হতে লাগল বেঁচে থাকাটা মন্দ ব্যাপার নয়। বেহেশতে নিশ্চয়ই হুর পরীরা এভাবে ঘাড় মালিশ করে দেবে। আমার ভেতরে একটা বেহেশতের ভাব চলে এল এবং ঠিক বেহেশতের মতো মুরগি রোস্টের গন্ধ পেতে লাগলাম।
বেহেশতি এই ভাবটা নিশ্চয়ই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। কারণ হঠাৎ করে আমার বোন বলল, মুরগি রোস্টের গন্ধ কোত্থেকে আসছে?
আমি চমকে উঠলাম, বললাম, তুমিও গন্ধ পাচ্ছ?
বোন অবিশ্যি পুরো ব্যাপারটিকে স্বর্গীয় অনুভূতি হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল না, হুঙ্কার দিয়ে বলল, বুয়া।