কেন? খারাপ লাগবে কেন?
ইঁদুর হলেও তো একটা প্রাণী। বিশেষ করে এরকম বুদ্ধিমান একটা প্রাণী। আইকিউ মানুষের সমান।
বিল্টু মাথা নাড়ল, বলল, না, মামা। আমার একটুও খারাপ লাগছে না।
একটুও না?
না। একটুও না। বরং খুব ভালো লাগছে।
আমি একটু অবাক হয়ে বিল্টুর দিকে তাকালাম, এইটুকুন ছেলে এরকম নিষ্ঠুর? জিজ্ঞেস করাম, তোর ভালো লাগছে?
হ্যাঁ। কেন জান?
কেন?
এই দেখ। বলে বিল্টু তার পকেটে হাত দেয় এবং সাবধানে হাতটা বের করে আনে, সেখানে জরিনি পিছনের দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে আছে। সেটি চুকচুক করে একবার বিল্টুর দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকাল। বিল্টু জরিনির মাথায় আঙুল দিয়ে আদর করে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই জরিনি। আর কেউ তোমাকে মারতে পারবে না।
জরিনি সম্মতি জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল। আমি অবাক হয়ে একটা চিৎকার দিয়ে রিকশা থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম। অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে বললাম, জ-জ-জরিনি মরে নি?
উঁহু। বিল্টু দাঁত বের করে হেসে বলল, কথা বলতে পারলে জরিনি বলত-আমি মরি নি!
কিন্তু, কিন্তু আমি আমতা-আমতা করে বললাম, আমরা স্পষ্ট শুনতে পেলাম তুই গুলি করেছিস!
ফাঁকা গুলি করেছি উপরের দিকে। তখনই জরিনি বুঝতে পারল আমি বাঁচাতে এসেছি। চোখ টিপে হাত দিয়ে ডাকতেই সুড়ুৎ করে চলে এল। কান থেকে রিংটা খুলে তাকে পকেটে রেখে দিয়েছি। একটুও শব্দ করে নি!
এখন যদি তোর হাত থেকে পালিয়ে যায়?
কেন পালিয়ে যাবে? আমি আর জরিনি এখন প্রাণের বন্ধু! তাই না জরিনি?
জরিনি ঠিক মানুষের মতো মাথা নাড়ল। বিলটু বলল, তা ছাড়া আমি সায়রা খালার কাছ থেকে হলুদ ট্যাবলেট নিয়ে এসেছি। সেটা এখন খাইয়ে দেব।
কীভাবে খাওয়াবি?
এই যে এইভাবে। বলে বিল্টু পকেট থেকে হলুদ ট্যাবলেটটা বের করে জরিনিকে জিজ্ঞেস করল, খিদে পেয়েছে?
জরিনি মাথা নাড়ল। বিল্টু তার হাতে ট্যাবলেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও খাও।
জরিনি কুটকুট করে খেতে থাকে, আমি রুদ্ধশ্বাসে সেদিকে তাকিয়ে থাকি, সমস্ত পৃথিবীর একটা মহাপ্রলয় থেকে উদ্ধার পাওয়া নির্ভর করছে এই ট্যাবলেটটা খেয়ে শেষ করার ওপরে।
.
সপ্তাহ খানেক পরে বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি–বোন আমাকে দেখে বলল, বুঝলি ইকবাল। তোকে সব সময় আমি অপদার্থ জেনে এসেছি। কিন্তু তুই দেখি ম্যাজিক করে দিলি।
কী ম্যাজিক?
বিল্টুর মাথা থেকে কম্পিউটারের ভূত দূর করে দিয়েছিস। সেই যে সেদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য নিয়ে গিয়েছিলি কীভাবে বুঝিয়েছিস কে জানে। ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। এখন দেখি দিন-রাত ঘরে দরজা বন্ধ করে হাতের কাজ করে।
হাতের কাজ?
হ্যাঁ। ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল তৈরি করেছে। একটা ছোট বিছানাও। সেদিন দেখি একটা খেলনা গাড়ির মাঝে কীভাবে কীভাবে ব্যাটারি দিয়ে একটা ইঞ্জিন বসাবে। দিন-রাত দেখি ব্যস্ত।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। লাইব্রেরি থেকে বই এনে বেশ পড়াশোনাও করে।
কীসের ওপর বই?
জন্তু-জানোয়ারের ওপর বই। শুরু করেছে ইঁদুরের বই দিয়ে।
আমি কেশে গলা পরিষ্কার করে বললাম, ও আচ্ছা!
আর কী একটা হয়েছে দুই চোখে বিড়াল দেখতে পারে না। বাসায় কোথা থেকে একটা হুলো বিড়াল এসেছিল, নিজে সেটাকে ধরে বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গার ঐ পারে ফেলে এসেছে।
আমি খুব অবাক হবার ভান করলাম। আপা অবিশ্যি হঠাৎ মুখ কালো করে বললেন, তবে
তবে কী?
এই বাসাটার কিছু একটা দোষ হয়েছে।
দোষ?
হ্যাঁ।
কী দোষ?
সেদিন দেখি সিলিং থেকে একটা জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি নিচে পড়ল।
জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি?
হ্যাঁ। একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আর কোনো মানুষ নেই জন নেই মাঝরাতে হঠাৎ করে কলিংবেল বাজতে থাকে।
কী আশ্চর্য!
বোন মুখ গম্ভীর করে বললেন, ভালো একটা বাসা পেলে জানাবি–এই দোষে পাওয়া বাসায় থাকতে চাই না।
ঠিক আছে আপা, জানাব।
বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিল্টুর সাথে দেখা করতে গেলাম। অন্যবারের মতো আমাকে দেখে মুখ কালো করে ফেলল না বরং তার মুখ পুরোপুরি এক শ ওয়াট না হলেও মোটামুটি চল্লিশ ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। আমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, জরিনির কী খবর?
বিল্টু ফিসফিস করে বলল, ভালো। তবে
তবে কী?
খুব মেজাজ গরম। পান থেকে চুন খসলে রক্ষা নাই। সেদিন একটু বকেছি তখন ম্যাচ নিয়ে সিলিঙে উঠে গেল। তারপর
জানি। আপা বলেছে।
তার সাথে না খেললে সারা রাত কলিংবেল বাজায়।
কী খেলিস?
দাবা। ওপেনিং মুভ যাচ্ছেতাই
ও।
খুব ভয়ে ভয়ে আছি মামা, কোন দিন না আম্মুর কাছে ধরা পড়ে যাই। আম্মু কম্পিউটারকে যত ঘেন্না করে ইঁদুরকে তার চেয়ে এক শ গুণ বেশি ঘেন্না করে।
আপাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। নেংটি ইঁদুরকে ভালবাসার কারণ আছে?
বিল্টু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, শ-স-স-স, জরিনি শুনলে খবর আছে!
.
শেষ খবর অনুযায়ী সায়রা সায়েন্টিষ্টের ডাল রাঁধার যন্ত্রের কাজ প্রায় শেষ। জরিনি আসলে মারা যায় নি শুনে সে খুব খুশি হয়েছে। বিল্টুকে সে রাখতে দিয়েছে তবে কঠিন একটা শর্ত আছে-কোথা থেকে পেয়েছে কাউকে বলতে পারবে না!
বিল্টুর তাতে সমস্যা নেই–সে যে একটা নেংটি ইঁদুর পেয়েছে সেই কথাটিই এখনো কেউ জানে না। আমি ছাড়া।
মালিশ মেশিন
আমার মাঝে মধ্যে ভালো-মন্দ খাওয়ার ইচ্ছে করলে বোনের বাসায় হাজির হই-কখনো অবিশ্যি স্বীকার করি না যে খেতে এসেছি, ভান করি এই দিকে কাজে এসেছিলাম যাবার সময় দেখা করে যাচ্ছি। বোনের বাসা দোতলায়-সিঁড়ি দিয়ে উঠছি হঠাৎ দেখি কে যেন ঠিক সিঁড়ির মাঝখানে একটা কলার ছিলকে ফেলে রেখেছে, মানুষের কাণ্ডজ্ঞান কত কম হলে এরকম একটা কাজ করতে পারে? কেউ যদি ভুল করে এই হিলকের উপর পা দেয় তা হলে কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটে যাবে– প্রথমত পা পিছলে সে পড়ে যাবে তারপর সিঁড়ি দিয়ে গাছের গুঁড়ির মতো গড়িয়ে যাবে। সিঁড়ির শেষ মাথায় পৌঁছে এসে সে দেওয়ালে আঘাত করবে তখন তার হাত-পা ভেঙে যাবে, মাথা ফেটে রক্তারক্তি হয়ে যাবে, কে জানে হয়তো ব্রেন ড্যামেজ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবে।