সায়রা সারাক্ষণই ইতিউতি তাকাচ্ছে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, সায়রা-কী হয়েছে?
সর্বনাশ হয়ে গেছে।
সর্বনাশ? আমি শুকনো গলায় বললাম, আপনার ডাল রান্নার মেশিনে কিছু গোলমাল?
সায়রা হাত নেড়ে বলল, আরে না! ডাল রান্নার মেশিনের কথা ছেড়ে দেন।
তা হলে?
আমার কথার উত্তর দেবার আগেই হঠাৎ করে মনে হল সায়রা তার হেডফোনে কিছু শুনতে পেল, সাথে সাথে তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল। সে হঠাৎ ঘুরে ছুটে যায় হাতের বিদঘুটে অস্ত্রটার ট্রিগার টেনে ধরে এবং সেখান থেকে বজ্রপাতের মতো একটা বিদ্যুৎ ঝলক বের হয়ে আসে, ঘরের ভেতরে একটা পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সাথে সাথে। বিল্টু চমকে উঠে আমার পিছনে লুকিয়ে আমার হাত খামচে ধরল ভয়ে। সায়রা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এই ঘরেই আছে এখন। পরিষ্কার সিগন্যাল পাচ্ছি।
আমি ভয়ে ভয়ে সায়রার দিকে তাকালাম, মনে হতে থাকে মেয়েটা হয়তো পাগলটাগল হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে আপনার?
আমার কিছু হয় নি। জিজ্ঞেস করেন, পৃথিবীর কী হয়েছে!
আমি শুকনো মুখে বললাম, কী হয়েছে পৃথিবীর?
পৃথিবীর মহাবিপদ।
কেন?
জরিনি পালিয়ে গেছে।
তাই বলেন! আমি বুক থেকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা বের করে দিয়ে বললাম, সেটা নিয়ে এত ঘাবড়ানোর কী আছে?
সায়রা হুঙ্কার দিয়ে বলল, কী বললেন আপনি? জরিনি পালিয়ে গেছে এবং সেটা নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই?
বিল্টু আমার হাত টেনে বলল, মামা জরিনি কে?
একটা ইঁদুর।
মনে হল সায়রা এই প্রথম বিল্টুকে দেখতে পেয়েছে, তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, এইটা কে?
আমার ভাগনে। নাম বিল্টু। খুব বুদ্ধিমান–আইকিউ বলতে পারেন জরিনির সমান।
বিল্টু জিজ্ঞেস করল, মামা, ইঁদুর আবার বুদ্ধিমান হয় কেমন করে?
আমি মাথা চুলকে বললাম, সেটা বলা নিষেধ–তাই না সায়রা?
সায়রা হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আর নিষেধ! জরিনি পালিয়ে গিয়ে যে সর্বনাশ করেছে এখন আর গোপন করে কী হবে?
কেন সর্বনাশ কেন?
বুঝতে পারছেন না কেন?
আমি মাথা চুলকে বললাম, না।
সায়রা হতাশার মতো একটা ভঙ্গি করে বলল, কারণ জরিনি হচ্ছে একটা নেংটি ইঁদুরী-
বিল্টু বাধা দিয়ে বলল, ইঁদুরী?
আমি বিল্টুকে থামিয়ে বললাম, ব্যাকরণ বইয়ে পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গ পড়িস নি? কুকুর কুকুরী, পিশাচ পিশাচী-সেরকম ইঁদুর ইঁদুরী। জরিনি হচ্ছে মেয়ে ইঁদুর-
কিন্তু বিল্টু আপত্তি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সায়রা তাকে সেই সুযোগ দিল না। বলল, নেংটি ইঁদুরের সাইজ মাত্র এতটুকু–তাদের শরীরের হাড়, জয়েন্ট পর্যন্ত ফ্লেক্সিবল। এক ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগ একটা ফুটো দিয়ে এরা বের হয়ে যেতে পারে। এদের অসাধ্য কোনো কাজ নেই। প্রতি বছর এরা কত কোটি টাকার ফসল নষ্ট করে জানেন?
আমি মাথা নাড়লাম, জানি না।
শুধু কি ফসল? জামাকাপড়, ঘরবাড়ি, গাছপালা-কিছু বাকি নেই। এরা ইচ্ছে করলেই সারা পৃথিবী দখল করে নিতে পারে, নিচ্ছে না শুধু মানুষের কারণে। মানুষ নেংটি ইঁদুরকে কন্ট্রোলের মাঝে রেখেছে।
সায়রা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, এখন চিন্তা করুন জরিনির কথা–সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী। আইকিউ এক শ কুড়ির কাছাকাছি। মানুষের সাথে সে পাল্লা দিতে পারে। পালিয়ে যাবার পর গত দুই দিন থেকে আমি তাকে পৃথিবীর সেরা যন্ত্রপাতি দিয়ে ধরার চেষ্টা করছি–ধরতে পারছি না। কপাল ভালো সে আমাদের কিছু করতে পারছে না, কারণ সে একা। কিন্তু
সায়রা হঠাৎ তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর করে থেমে গেল। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু?
কিন্তু সে একা থাকবে না।
কেন একা থাকবে না?
কারণ জরিনি ঘরসংসার করবে। তার বাচ্চাকাচ্চা হবে। বুদ্ধির জিনিসটা কোন কমোজমে আছে জানি না, কিন্তু যেখানেই থাকুক তার বাচ্চাকাচ্চার মাঝে সেই বুদ্ধি ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের হিসেবে জরিনি হচ্ছে কিশোরী বালিকা। অন্তত এক ডজন বাচ্চা হবে তার-সেখান থেকে ডজন ডজন নাতি-সেখান থেকে ডজন ডজন ডজন পুতি-বুঝতে পারছেন?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বুঝেছি একজন বুদ্ধিমান ইঁদুরী থেকে বারোটা বাচ্চা, চব্বিশটা নাতি, ছত্রিশটা পূতি-।
বিল্টু মাথা নাড়ল, বলল, না মামা। তুমি মনে হয় জীবনে অঙ্কে পাস কর নাই। এক ডজন বাচ্চা হলে নাতি হবে এক শ চুয়াল্লিশ আর পুতি হবে দেড় হাজারের মতো। সংখ্যাটা যোগ নয়-গুণ হবে।
সায়রা মাথা নাড়ল। বলল, ঠিক বলেছ। সঠিক সংখ্যা হবে এক হাজার সাত শ আটাশ। এই পুতিদের পূতি যখন হবে তাদের সংখ্যা হবে তিন মিলিয়ন। এখন চিন্তা করেন-ঢাকা শহরে তিন মিলিয়ন নেংটি ইঁদুর যাদের আইকিউ এক শ বিশ। চিন্তা করতে পারেন কী হবে?
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, ইয়ে মানে
সকল খাবার তারা দখল করে নেবে। টেলিফোনের তার কেটে যোগাযোগ নষ্ট করে দেবে। ইলেকট্রিক কন্ট্রোল সিস্টেমের তার কেটে পাওয়ার সাপ্লাই নষ্ট করে দেবে। দেশে কোনো ইলেকট্রিসিটি থাকবে না। ফাইবার অপটিক লাইন কেটে নেটওয়ার্ক নষ্ট করে দেবে। যে কোনো যন্ত্রের ভিতরে ঢুকে টুক করে একটা তার কেটে যন্ত্রটা নষ্ট করে দেবে। কম্পিউটার অচল হয়ে যাবে। ট্রেন চলবে না–গাড়ি চলবে না। প্লেন ক্র্যাশ করে যাবে। দেশের মানুষ খেতে পাবে না। পাবলিক খেপে যাবে। দেশে আন্দোলন হবে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে- সায়রা কথা বলতে বলতে শিউরে উঠল।