কেন কথা বলবে না?
মনে করবে আমি ন্যাদা ন্যাদা বাচ্চা!
আপা বলল, সেটা তোর আর তোর এই নিষ্কর্মা অপদার্থ মামার মাথাব্যথা। খেয়ে তোরা এই বাড়ি থেকে বের হবি। রাত নয়টার আগে আমি তোদের দেখতে চাই না।
আমি দুর্বলভাবে আপত্তি করার চেষ্টা করলাম, আপা ভাতের চামচ দিয়ে ডাইনিং টেবিলে ঘটাং করে মেরে আমাকে থামিয়ে দিল।
.
কাজেই দুপুরবেলা আমি বিল্টুকে নিয়ে বের হলাম। বিল্টুর মুখ শুকনো, আমার মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু নিশ্চয়ই আমশি মেরে আছে। রাস্তার মোড় থেকে একটা রিকশা নিয়েছি। রিকশায় উঠে দুইজনের কেউই কথা বলছি না, অনেকক্ষণ পর বিল্টু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সব দোষ তোমার মামা।
কেন, আমার কেন হবে?
তুমি যদি ই-মেইলের কথা না বলতে তা হলেই আজকের এই সর্বনাশটা হত না।
সর্বনাশ? কোন জিনিসটাকে সর্বনাশ বলছিস?
এই যে তোমার সাথে আজকে সারা দিন থাকতে হবে।
আমি এভাবে বিল্টুর থেকেও একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, মামার সাথে থাকা তোর কাছে সর্বনাশ মনে হচ্ছে?
সর্বনাশ নয় তো কী? তুমিই বলল, তুমি কী ইন্টারেষ্টিং জিনিস করতে পার, বলো?
আমরা দুইজনে মিলে একটা সিনেমা দেখতে পারি। অনেক দিন থেকে আমি সিনেমা দেখি না। সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখার মজাই অন্যরকম।
বিল্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মামা, তুমি দুনিয়ার কোনো খবর রাখ না। তাই না?
কেন?
এই সপ্তাহে যে দুইটা সিনেমা রিলিজ হয়েছে তুমি তার নাম জান?
না, জানি না। কেন, কী হয়েছে?
একটার নাম হচ্ছে কিলিয়ে ভর্তা, অন্যটার নাম হচ্ছে টেংরিতে লেংড়ি। কাহিনী শুনতে চাও?।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, দেশটাতে হচ্ছেটা কী? সিনেমা হচ্ছে একটা শিল্পমাধ্যম। তার নাম কিলিয়ে ভর্তা?
বিল্টু বলল, মামা তুমি আসলে খুব ভালো আছ, দেশের কোনো কিছু জান না, খবরের কাগজ পড় না, মহানন্দে আছ।
তা হলে চল চিড়িয়াখানায় যাই।
না মামা। চিড়িয়াখানায় সব জন্তু-জানোয়ার বাথরুম করে রেখেছে, দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না।
তা হলে শিশুপার্কে যাবি?
বিল্টু চোখ কপালে তুলে বলল, শিশুপার্কে? আমি? আমি কি শিশু নাকি?
শিশু নয় তো কী? তোর কী এমন বয়স?
বিল্টু মাথা নেড়ে বলল, মামা তুমি জান না। শিশুপার্কে যায় বয়স্ক মানুষেরা, যাদের বুদ্ধি কম শিশুদের সমান।
পার্কে যাবি?
গতকালকেই পার্কে দুইটা ছিনতাই হয়েছে।
তা হলে কোথায় যাবি?
বিল্টু চোখ নাচিয়ে বলল, এলিফেন্ট রোডে একটা কম্পিউটারের দোকান আছে।
আমি শিউরে উঠে বললাম, সর্বনাশ! আপা একেবারে খুন করে ফেলবে না?
বিল্টু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তা হলে আর কী করব? রিকশাতেই বসে থাকি রাত নয়টা পর্যন্ত।
আমি খুব দুশ্চিন্তার মাঝে পড়ে লাম, বারো বছরের একটা ছেলেকে নিয়ে সময় কাটানোর মতো কোনো বুদ্ধিই বের করতে পারব না? অনেক চিন্তা করে বললাম, আমার একজন বন্ধু আছে। যা সুন্দর ক্লাসিক্যাল গান গায়!
বিল্টু শিউরে উঠল। আমি বললাম, একজন আর্টিষ্ট বন্ধু আছে তার বাসায় যাবি? মডার্ন আর্ট করে-
বিল্টু মাথা নাড়ল, বলল, মডার্ন আর্ট দেখলে ভয় করে।
পরিচিত একটা ভণ্ডপীরের বাসায় যাবি? যা ভংচং করে, দেখলে তোর তাক লেগে যাবে
বিল্টু এবারে খানিকটা কৌতূহল দেখাল কিন্তু ভিতরে গিয়ে পায়ে ধরে সালাম করতে হবে শুনে শেষ পর্যন্ত বেঁকে বসল। তখন আমার সায়রা সায়েন্টিস্টের কথা মনে পড়ল। বললাম, একজন সায়েন্টিস্টের কাছে যাবি?
কোন সায়েন্টিস্ট?
ঐ যে আজকে ই-মেইল পাঠিয়ে দেখা করতে বলেছে।
কী আবিষ্কার করেছে?
অনেক কিছু। দেখলে হাঁ হয়ে যাবি। সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হচ্ছে একটা ই- হঠাৎ আমার মনে পড়ল আমি সায়রাকে কথা দিয়েছি তার বুদ্ধিমান ইঁদুরী জেরিনির কথা কাউকে বলব না। কথা শেষ না করে থেমে গেলাম।
বিল্টু পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, কী? বলো।
বলা যাবে না।
কেন?
এটা সিক্রেট। আমি সায়রাকে কথা দিয়েছি কাউকে বলব না।
এই প্রথমবার বিল্টুর চোখ কৌতূহলে জ্বলজ্বল করতে থাকে। খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চল যাই সায়রা সায়েন্টিস্টের কাছে।
আমি আর বিল্টু তখন সায়রা সায়েন্টিষ্টের বাসার দিকে রওনা দিলাম। যদি রওনা না দিতাম তা হলে পৃথিবীর ইতিহাসই হয়তো অন্যরকম করে লেখা হত।
.
বাসায় গিয়ে কয়েকবার বেল টিপলাম কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল। আবার টিপব না চলে যাব যখন বুঝতে পারছিলাম না, তখন হঠাৎ খুট করে দরজাটা খুলে গেল। খুব অল্প একটু দরজা ফাঁক করে সায়রা আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ঢুকে পড়েন। তাড়াতাড়ি।
দরজার এক ইঞ্চি ফাঁক দিয়ে কেমন করে আস্ত একটা মানুষ ঢুকতে পারে আমি বুঝতে পারলাম না। আমি ইতিউতি করছিলাম কিন্তু তার মাঝে বিন্দু দরজা টেনে ফাঁক করে ভিতরে ঢুকে গেছে। সায়রা মহা সর্বনাশ হয়ে গেছে এরকম ভান করে একেবারে হা হা করে উঠল এবং তার মাঝে আমিও ভিতরে ঢুকে গেলাম এবং সাথে সাথে সায়রা ঝপাং করে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি অবাক হয়ে সায়রার দিকে তাকালাম, তাকে দেখাচ্ছে হলিউডের সিনেমার নায়িকাদের মতো। পিঠে যন্ত্রপাতি বোঝাই ব্যাকপেক, হাতে বিদঘুটে একটা অস্ত্র, কানে হেডফোন, মাথায় একটা টুপি এবং সেই টুপির ওপরে পাখার মতো একটা যন্ত্র আস্তে আস্তে ঘুরছে। সায়রার চুল উসকোখুসকো, চোখর নিচে কালি, গায়ে কালিঝুলি মাখা একটা ওভারঅল, শুধু মেয়ে বলে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নেই। আমি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে সায়রার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, কী হয়েছে?