- বইয়ের নামঃ সায়রা সায়েন্টিস্ট
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ বিদ্যাপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
জরিনি ইঁদুর
মগবাজারের মোড়ে স্কুটার থেকে নেমে আমি পকেট থেকে তিনটা দশ টাকার নোট বের করে স্কুটার ড্রাইভারের হাতে দিলাম। ড্রাইভার নোট তিনটার দিকে একনজর দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, পঁয়ত্রিশ টাকা ভাড়া।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পঁয়ত্রিশ টাকা?
স্কুটার ড্রাইভার তার পান খাওয়া দাঁত বের করে একগাল হেসে বলল, জে। পঁয়ত্রিশ টাকা।
আপনি না ত্রিশ টাকায় রাজি হলেন?
ড্রাইভার তার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত করে বলল, জে না। রাজি হই নাই।
সে কী! আমি রেগে উঠে বললাম, আপনি পঁয়ত্রিশ টাকা চেয়েছিলেন। আমি বললাম, ত্রিশ টাকায় যাবেন? আমার স্পষ্ট মনে আছে আপনি মাথা নাড়লেন।
স্কুটার ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে বলল, মাথা নেড়েছিলাম?
হ্যাঁ।
স্কুটার ড্রাইভার মুখ গম্ভীর করে তার মাথাটা নেড়ে দেখিয়ে বলল, এইভাবে?
হ্যাঁ। এইভাবে।
ড্রাইভারের মুখের গাম্ভীর্য সরে সেখানে আবার মধুর হাসি ফুটে উঠল। সে তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, সেটা অন্য ব্যাপার।
অন্য কী ব্যাপার?
গত রাতে বেকায়দা ঘুম গেছিলাম তাই ঘাড়ে ব্যথা।
ত্রিশ টাকা ভাড়ার সাথে ঘাড়ে ব্যথার কী সম্পর্ক বুঝতে না পেরে আমি অবাক হয়ে বললাম, ঘাড়ে ব্যথা?
জে। রগে টান পড়েছে। সকালবেলা গরম সরিষার তেলে রসুন দিয়ে মালিশ করেছি। একটু পরে পরে মাথা নাড়ি তখন ঘাড়ের এক্সারসাইজ হয়।
তার মানে তার মানে- আমি রেগে গিয়ে কথা শেষ করতে পারি না, কিন্তু স্কুটারওয়ালা একেবারেই বিচলিত হয় না। মুখে আরো মধুর হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি মাথা নাড়লাম ঘাড় ব্যথার কারণে আর আপনি ভাবলেন ত্রিশ টাকায় রাজি হয়েছি। হা-হা-হা-
আমি হতবুদ্ধি হয়ে স্কুটারওয়ালার দিকে তাকিয়ে রইলাম-ত্রিশ টাকার জায়গায় পঁয়ত্রিশ টাকা ভাড়া দিতে আমার যে একেবারে জীবন চলে যাবে তা নয়, কিন্তু কেউ যে এরকম একটা অদ্ভুত কাণ্ড করতে পারে আমার বিশ্বাস হয় না। স্কুটারওয়ালা তার কেনে আঙুলটা কানে ঢুকিয়ে নির্মমভাবে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, আজকাল কি ত্রিশ টাকা স্কুটার ভাড়া আছে? নাই। চাক্কা ঘুরলেই চল্লিশ টাকা। আপনাকে দেখে মনে হল সোজাসিধে মানুষ, তাই মায়া করে বললাম পঁয়ত্রিশ টাকা
মায়া করে বলেছেন পঁয়ত্রিশ টাকা? আমার নাকি ব্লাড প্রেসার বেশি, ডাক্তার বলেছে রাস্তাঘাটে রাগারাগি না করতে-তাই অনেক কষ্ট করে মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে বললাম, মায়া করে আর কী কী করেন আপনি?
আমার কথা শুনে মনে হল স্কুটার ড্রাইভারের মুখে একটা গভীর বেদনার ছাপ পড়ল। সে মাথা নেড়ে বলল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না স্যার? আপনার মুখে একটা মাসুম মাসুম ভাব আছে-দেখলেই মায়া হয়। আমার কথা বিশ্বাস না করলে এই আপাকে জিজ্ঞেস করেন।
স্কুটার ড্রাইভার কোন আপার কথা বলছে দেখার জন্য মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, আমাদের দুইজনের খুব কাছেই শাড়ি পরা একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে কিছুটা মোবাইল ফোন কিছুটা ক্যালকুলেটরের মতো একটা যন্ত্র। সেই মেয়েটি কিংবা মহিলাটি মনে হল খুব মনোযোগ দিয়ে আমার সাথে স্কুটার ড্রাইভারের কথাবার্তা শুনছে। ড্রাইভার তাকে সালিশ মানার পর সে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছে।
কী ঠিক বলেছে? ডাক্তারের কড়া নির্দেশ তাই আমি কিছুতেই গলার স্বর উঁচু করলাম না, আমার চেহারাটা মাসুম মাসুম সেইটা, নাকি আমার ওপরে মায়া করে সে স্কুটার ভাড়া বেশি নিচ্ছে সেইটা।
মেয়েটা আমার কথায় উত্তর না দিয়ে বলল, ইন্টারেস্টিং!
কী ইন্টারেস্টিং?
আপনি ভাব করছেন যে আপনি রাগেন নি-কিন্তু আসলে আপনি খুব রেগে গেছেন। পাঁচ টাকার জন্য মানুষ এত রাগ করতে পারে আমি জানতাম না।
আমি গলার স্বর একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা করে বললাম, আপনি কেমন করে জানেন যে আমি রাগ করছি?
মেয়েটা কিছুটা মোবাইল ফোন কিছুটা ক্যালকুলেটরের মতো দেখতে যন্ত্রটা আমাকে দেখিয়ে বলল, আমার ভয়েস সিন্থেসাইজার বলে দিচ্ছে। আজকেই প্রথম ফিল্ড টেস্ট করতে বের করেছি। এক্সেলেন্ট কাজ করছে। এই দেখেন।
মেয়েটা কী বলছে বুঝতে না পেরে আমি হা করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা উৎসাহ নিয়ে বলল, প্রত্যেকটা মানুষের ভোকাল কর্ডের কিছু ন্যাচারাল ফ্রিকোয়েন্সি থাকে। মানুষ যখন রেগে যায় তখন কয়েকটা ওভারটোন আসে। এই দেখেন আপনার মেগা ওভারটোন-যার অর্থ আপনি রেগে ফায়ার হয়ে আছেন।
একজন মানুষ বিশেষ করে একজন অপরিচিত মেয়েমানুষ যদি একটা যন্ত্র দিয়ে বের করে ফেলে আমি রেগে ফায়ার হয়ে আছি তখন রেগে থাকা ঠিক না-তাই আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম মেজাজটাকে নরম করার জন্য। স্কুটার ড্রাইভার এই সময় আবার তাগাদা দিল, স্যার, ভাড়াটা দিয়ে দেন আমি যাই।
মানুষের মেজাজ কতটুকু গরম হয়েছে বের করে ফেলার আজব যন্ত্রটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি হাসি হাসি মুখে বলল, দিয়ে দেন। ড্রাইভার সত্যি কথাই বলছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কেমন করে জানেন?
মেয়েটা হাতে ধরে রাখা যন্ত্রটা উঁচু করে বলল, আমার ভয়েস সিন্থেসাইজারের ফিল্ড টেস্ট হচ্ছে। মিথ্যা কথা বললে হায়ার হারমনিক্স আসে। এই দেখেন ড্রাইভারের গলার স্বরে কোনো হায়ার হারমনিক্স নাই।