শাহনাজ লজ্জায় লাল হয়ে বলল, ক্যাপ্টেন ডাবলু—-আমি আসলে আনসার্টেনিটি প্রিন্সিপাল জানি না।
ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এইটাই হচ্ছে সমস্যা। এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলার কোনো লোক পাই না।
তোমার স্কুলের স্যারদের সাথে চেষ্টা করে দেখেছ?
ক্যাপ্টেন ডাবলু কেমন জানি আতঙ্কের দৃষ্টিতে শাহনাজের দিকে তাকাল, বলল, তুমি কি পাগল হয়েছ শাহনাজ আপু? একবার চেষ্টা করেছিলাম। স্যার মনে করেছে আমি তার সাথে মশকরা করছি, তারপর আমাকে ধরে সে কী পিটুনি!
শাহনাজ মাথা নাড়ল, তার হঠাৎ মোবারক আলী স্যারের কথা মনে পড়ে গেল। স্যার আশপাশে নেই জেনেও সে হঠাৎ কেমন জানি শিউরে ওঠে। ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তবে লান্টুকে বললে সে খুব মন দিয়ে শোনে। কোনো আপত্তি করে না। বেশিক্ষণ বললে শুধু ঘুমিয়ে যায়, এইজন্যে একটানা বেশিক্ষণ বলা যায় না।
শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না। দশজন থেকে আলাদা হওয়ার মনে হয় খুব বড় সমস্যা। তার হঠাৎ এই ছোট বিজ্ঞানীটির জন্য একরকম মায়া হতে থাকে।
০৪. সকালবেলা শাহনাজের ঘুম ভাঙল
সকালবেলা শাহনাজের ঘুম ভাঙল এক ধরনের মনখারাপ ভাব নিয়ে। এখানে সে বেড়াতে এসেছিল আনন্দ করার জন্য এখন বোঝাই যাচ্ছে আনন্দ দূরে থাকুক, সময় কাটানো নিয়ে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। মন ভালো থাকলে যেটাই করা যায় তাতেই আনন্দ হয়, আর মন খারাপ থাকলেই কিছুই করতে ভালো লাগে না। এখানে আসার সময় এতগুলো মজার মজার বই নিয়ে এসেছে, এখন কোনোটাই খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে না। সোমাকে যদি হাসপাতালেই থাকতে হয় তা হলে শাহনাজদের তো আর একা একা বাসায় থাকার কোনো কারণ নেই। কীভাবে ফিরে যাবে ইমতিয়াজের সাথে কথা বলে সেটা ঠিক করতে হবে পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে শাহনাজের আরো বেশি মনখারাপ হয়ে গেল।
ঘুম থেকে উঠে নাশতা করার সময় শাহনাজ আবিষ্কার করল ইমতিয়াজ কোথায় জানি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই জেনেও শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
উত্তর না দিয়ে মুখ ভেংচে টিটকারি করে কিছু একটা বলবে ভেবেছিল কিন্তু শাহনাজকে অবাক করে দিয়ে ইমতিয়াজ প্রশ্নের উত্তর দিল। বলল, ঝরনাটা নিজের চোখে দেখে আসতে চাই। জলজ্যান্ত একটা ঝরনা কীভাবে উধাও হতে পারে ইনভেস্টিগেট করা দরকার। মুখে খুব একটা গভীর ভাব করে বলল, মনে হয় কোনো জিওলজিক্যাল একটিভিটি হচ্ছে। দেখে আসি।
ইমতিয়াজের প্রস্তুতি দেখে অবশ্য মনে হল সে দুই মাইল দূরে একটা ঝরনা দেখতে যাচ্ছে না, মরুভূমি বন প্রান্তর সমুদ্র পার হয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযান করতে যাচ্ছে। একটা ব্যাক প্যাকে তার জন্য দুইটা স্যান্ডুউইচ, দুইটা কোল্ড ড্রিংক এবং কিছু ফলমূল দিতে হল। ব্যান্ডেজ, এন্টিসেপটিক লোশন, মাথাব্যথার ট্যাবলেট, ছুরি, নাইলনের দড়ি কিছুই বাকি থাকল না। টি–শার্টের ওপর সোয়েটার, তার ওপর জ্যাকেট, মাথায় বেসবল ক্যাপ, পায়ে টেনিস শু–এক কথায় পুরোপুরি অভিযাত্রী। রওনা দেওয়ার সময় অবশ্য কাজের ছেলেটাকে সাথে সাথে যেতে হল কারণ ইমতিয়াজের নিজের দুই মাইল ব্যাক প্যাক টেনে নেওয়ার শক্তি নেই এবং এই নির্জন জংগুলে জায়গায় যদি বাঘ–ভালুক তাকে খেয়ে ফেলে। সেটা নিয়েও একটা ভয় রয়েছে।
ইমতিয়াজ চলে যাবার পর শাহনাজ সোমার খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করল। কোনো একটি বিচিত্র কারণে চা–বাগানে টেলিফোনের অবস্থা খুব ভালো না। সোমাদের বাসায় যেটা আছে সেটা দিয়েও খুব সহজে কোথাও ডায়াল করা যায় না। সোমা যে হাসপাতালে আছে সেটার টেলিফোন নম্বরটাও জানা নেই–ইচ্ছে থাকলেও পেঁজ নিতে পারবে না। চা–বাগানের একটা। বড় ফ্যাক্টরি আছে, সেখানে অনেকে আছেন, তাদের সাথে কথা বললে হয়তো কেউ খোঁজ দিতে পারবে। শাহনাজ দুপুরবেলা একবার ধোঁজ নেওয়ার জন্য বের হবে বলে ঠিক করল।
শাহনাজের হিসাব অনুযায়ী ইমতিয়াজ ফিরে আসতে আসতে একেবারে বিকেল হয়ে যাবার কথা–শহুরে আঁতেল ধরনের মানুষেরা আসলে দুর্বল প্রকৃতির হয়, সিগারেট খেয়ে ফুসফুঁসের বারোটা বাজিয়ে রাখে বলে হাঁটাহাঁটি করতে পারে না। পাহাড়ি জঙ্গলের পথে দুই মাইল হেঁটে যেতে এবং ফিরে আসতে ইমতিয়াজের একেবারে বারোটা বেজে যাবে– কাজেই সে যে বেলা ডুবে যাবার আগে ফিরে আসতে পারবে না, সে ব্যাপারে শাহনাজের কোনো সন্দেহই ছিল না। ফিরে এসেও সে যে এই দুই মাইল হেঁটে যাওয়া নিয়ে এমন বিশাল একটা গল্প ফেঁদে বসবে শাহনাজ সেটা নিয়েও একেবারে নিশ্চিত ছিল।
কিন্তু আসলে যেটা ঘটল সেটার জন্য শাহনাজ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ইমতিয়াজ। ফিরে এল দুপুরের আগেই এবং যখন সে ঘরে এসে ঢুকেছে তখন তাকে দেখলে যে–কেউ বলবে সে বুঝি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। উত্তেজনায় সে কথাই বলতে পারছিল না। কাজেই কাজের ছেলেটার কাছে জিজ্ঞেস করতে হল। কিন্তু সে মাথা চুলকে জানাল যে ইমতিয়াজ কী বিষয় নিয়ে এত উত্তেজিত হয়ে আছে সে বুঝতে পারছে না। তার ধারণা ইমতিয়াজ সেখানে কিছু একটা দেখে এসেছে। শাহনাজ খুব কৌতূহল নিয়ে ইমতিয়াজকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া তুমি কী দেখেছ?
ইমতিয়াজ উত্তর না দিয়ে বুকে থাবা দিয়ে বলল, আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি। ওয়ার্ল্ড ফেমাস। কেউ আর আটকাতে পারবে না।