.
সোমার খবর পেয়ে শাহনাজের মনটা একটু শান্ত হয়েছে। বিকেলবেলা সে তখন আবার হাঁটতে বের হল। চা–বাগানের শ্রমিকেরা কাজ শেষে ফিরে আসছে, ছোট ছোট বাচ্চারা মায়ের পিছু পিছু ছুটে যাচ্ছে। সবাই ধুলায় পা ডুবিয়ে হেঁটে যাচ্ছে–দেখে কী মজা লাগে! শাহনাজ একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সে যদি এ রকম খালি পায়ে ধুলায় ছুটে যেত তা হলে সবাই নিশ্চয়ই হা হা করে বলবে, সর্বনাশ! সর্বনাশ! হকওয়ার্ম হবে। টিটেনাস হবে! হ্যাঁন হবে। ত্যান হবে!
চা–বাগানের পথ ধরে আরো কিছুদূর হেঁটে গিয়ে হঠাৎ ক্যাপ্টেন ডাবলুকে পেয়ে গেল, বিদঘুঁটে কী একটা জিনিস কানে লাগিয়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা শুনছে। শাহনাজ এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ক্যাপ্টেন ডাবলু! কী শুনছ এত মন দিয়ে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু শাহনাজকে দেখে বেশ খুশি হয়ে উঠল। বলল, নতুন একটা ট্রান্সমিটার তৈরি করেছি তো, সেটার রেঞ্জ টেস্ট করছি। অনেকদূর থেকে শোনা যায়।
তাই নাকি?
হুম।
দেখি কী রকম শোনা যায়?
শাহনাজকে শুনতে দিতে ক্যাপ্টেন ডাবলুর কেমন যেন উৎসাহের অভাব মনে হল। একরকম জোর করেই শাহনাজকে বিদ্ঘুটে জিনিসটা নিয়ে কানে লাগাতে হল এবং কানে লাগাতেই সে একেবারে চমকে ওঠে, শুনতে পেল কেউ একজন প্রচণ্ড বকাবকি করছে, কান। ছিঁড়ে ফেলব পাজি ছেলে–এক্ষুনি এসে দরজা খুলে দে, না হলে দেখিস আমি তোর কী অবস্থা করি।
শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, কে কথা বলছে?
আম্মা।
কাকে বকছেন?
আমাকে।
কেন?
আমার ট্রান্সমিটার টেস্ট করার জন্য একজন মানুষের দরকার ছিল, কাউকে পাই না। তাই–_
শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, তাই কী?
তাই আমাকে ঘরের বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছি, জানালায় রেখেছি মাইক্রোফোন। আম্মা একটানা চিৎকার করছে তাই টেস্ট করতে খুব সুবিধে।
শাহনাজ কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারে না। কোনোমতে সামলে নিয়ে বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? যাও এক্ষুনি দরজা খুলে দিয়ে এস।
ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, তুমি পাগল হয়েছ শাহনাজ আপু? এখন বাসায় গেলে উপায় আছে? আম্মা আস্ত রাখবে ভেবেছ?
তা হলে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু পকেট থেকে আরেকটা যন্ত্র বের করল, সেখানে কী একটা টিপে দিয়ে বলল, দরজা খুলে দিলাম। রিমোট কন্ট্রোল। সন্ধেবেলা রাগ কমে যাবার পর বাসায় যাব।
শাহনাজ খানিকক্ষণ ঐ বিচিত্র ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এইসব তুমি নিজে তৈরি করেছ?
হুম।
তার মানে তুমি একজন জিনিয়াস? সব কিছু বোঝ?
বইয়ে লেখা থাকলে সেটা বুঝি।
পরীক্ষায় তুমি ফার্স্ট হও?
ক্যাপ্টেন ডাবলু একটু অবাক হয়ে শাহনাজের দিকে তাকাল, পরীক্ষায় কীভাবে ফাস্ট হব? পরীক্ষায় কি এইগুলো লিখতে দেয়? গতবার তো আমার পাস করা নিয়ে টানাটানি হয়েছিল। আব্ব গিয়ে হেডমাস্টারকে অনেক বুঝিয়ে কোনোভাবে প্রমোশন দিতে রাজি করিয়েছে। ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর যা বিপদ হয়েছে!
কী বিপদ?
আব্বা আমার পুরো ল্যাবরেটরি বইপত্র সব জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই জন্যই তো আসল এক্সপেরিমেন্টগুলো টপ সিক্রেট করে ফেলেছি!
শাহনাজ খানিকক্ষণ এই বিচিত্র ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি একটু পড়াশোনা করলেই তো সব পারবে। পারবে না?
নাহ।
কী বলছ পারবে না! নিশ্চয়ই পারবে।
না, আমি পড়তেই পারব না। যেটা পড়তে ভালো লাগে না সেটা পড়ার চেষ্টা করলে ব্রেনের নিউরনগুলোর সব সিনান্স উল্টাপাল্টা হয়ে যায়।
শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, তোমার কী কী জিনিস পড়তে ভালো লাগে না?
বাংলা ইংরেজি ইতিহাস ভূগোল পৌরনীতি এইসব।
আর কী পড়তে ভালো লাগে?
ক্যালকুলাস, ফিজিক্স এইসব।
শাহনাজ চমকে উঠল, ১১/১২ বছরের ছেলে, ক্যালকুলাস করতে পারে! সে একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি ক্যালকুলাস পার?
বেশি পারি না। একটা রকেট পাঠালে সেটা অরবিটে যেতে হলে কী করতে হবে সেইটা করার জন্য ক্যালকুলাস শিখেছিলাম। তারপরে দেখলাম–
কী দেখলে?
কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করেই বের করে ফেলা যায়।
তুমি কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করতে পার?
কিছু পারি। ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, কিন্তু আমার আম্মা বেশিক্ষণ আমাকে কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেয় না।
তুমি কী কী প্রোগ্রামিং কর?
জাভা, সি প্লাস প্লাস এইসব সোজা সোজা প্রোগ্রাম। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সটা ভালো পারি না। দাবা খেলার একটা প্রোগ্রাম লিখেছি, একেবারে ভালো হয় নাই। বারো চৌদ্দ দানের মাঝে হারিয়ে দেওয়া যায়।
শাহনাজ আড়চোখে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে দেখল। তাদের বাসাতেও একটা কম্পিউটার আছে। খুব সাবধানে সেখানে কম্পিউটার–গেম খেলা হয়, তার বেশি কিছু নয়। আর এই বাচ্চা ছেলে সেখানে নাকি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে প্রোগ্রামিং করে! কী সাংঘাতিক ব্যাপার! শাহনাজ ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, ফিজিক্সে তুমি কী কী পড়?
সবচেয়ে ভালো লাগে রিলেটিভিটি।
তুমি রিলেটিভিটি জান?
শুধু স্পেশাল রিলেটিভিটি। জেনারেলটা বুঝি না। খুব কঠিন।
ও
আমার মনে হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সটা ঠিক না। কিছু ভুলত্রুটি আছে।
ভুলত্রুটি আছে?
হা। যেমন মনে কর আনসার্টেনিটি প্রিন্সিপাল বলে এনার্জি আর টাইম একসাথে মাপা যায় না। এখন যদি মনে কর।