ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আসলে ঝুমুরটা হচ্ছে সত্যিকারের পাজি। সে সবাইকে বলে দিয়েছে।
ঝুমুরটা কে?।
স্বপনের বোন। এক নম্বর পাজি। ইনডাকশন কয়েল দিয়ে একবার ইলেকট্রিক শক দিতে হবে।
স্বপনটা কে?
ঝুমুরের ভাই–সেটাও মিচকে শয়তান
শাহনাজ বুঝতে পারল ক্যাপ্টেন ডাবলুর সাথে এই বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। যাদেরকে সে পাজি এবং মিচকে শয়তান বলছে তাদের কথা বলার সাথে সাথে তার মুখে এক ধরনের আনন্দের হাসি ফুটে উঠছে, এবং যতদূর মনে হয় লাল্ট, ঝুমুর বা স্বপনের মতো বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়েই তার এক ধরনের মজার খেলা চলছে।
শাহনাজের ধারণা কিছুক্ষণের মাঝেই সত্যি প্রমাণিত হল। আরো কিছু বাচ্চাকাচ্চা এসে নিচে ছোটাছুটি করতে লাগল এবং গাছের উপরে বসে ক্যাপ্টেন ডাবলু লাফঝাঁপ দিতে লাগল। শাহনাজ খানিকক্ষণ এক ধরনের কৌতুক নিয়ে তাদের এই বিচিত্র খেলা লক্ষ করে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে বলল, তোমরা খেল, আমি এখন যাই।
খেলা! এইটা খেলা কে বলেছে?
তা হলে এইটা কী?
আমার টপ সিক্রেট ল্যাবরেটরি দখল করতে চাইছে দেখছ না?
ও। তুমি কী করবে?
মনে হয় ফাইট করতে হবে।
শাহনাজ দেখতে পেল ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা লাঠির আগায় একটা সাদা রুমাল বেঁধে নাড়তে থাকে। সে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, এইটা কী?
ফাইটটা কীভাবে করতে হবে সেটার নিয়মকানুন ঠিক করতে হবে না?
শাহনাজ দেখতে পেল নিচের ছেলেপিলেরা সঙ্কেত পেয়ে গাছের নিচে এসে হাজির হয়েছে। ক্যাপ্টেন ডাবলু ভয়ঙ্করদর্শন কিছু অস্ত্র নিয়ে গাছ থেকে নেমে এল। শাহনাজও নিচে নেমে আসে। টপ সিক্রেট ল্যাবরেটরি দখল করা নিয়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং যে যুদ্ধ শুরু হবে তার মাঝে থাকার মনে হয় তার কোনো দরকার নেই। ক্যাপ্টেন ডাবলুকে সে বলল, আমি গেলাম, তোমরা যুদ্ধ কর।
ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি থাকবে না আমার সাথে? আমি একা কেমন করে যুদ্ধ করব?
আমি আসলে যুদ্ধ করতে পারি না।
কেন পার না? কী–মজা–হবে আপু তো পারত।
উপস্থিত বাচ্চাকাচ্চারা সবাই মাথা নাড়ল, শাহনাজ বুঝতে পারল সোমা নিশ্চয়ই এই বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে এই ছেলেমানুষি খেলায় অনেক সময় দিয়েছে। সোমার কথা মনে পড়ে আবার তার মন খারাপ হয়ে গেল, সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা খেল, আমি একটু বাসায় যাই, দেখি সোমা আপুর কোনো খবর পাই কি না।
.
বাসায় এসে দেখল ইমতিয়াজ খুব তিরিক্ষে মেজাজে বসে আছে। খবরের কাগজ আসতে দেরি হচ্ছে বলে তার মেজাজ ভালো নেই। একদিন খবরের কাগজ একটু দেরি করে পড়লে কী হয় কে জানে। শাহনাজ বলল, তুমি যে বইটা এনেছ সেটা পড়লেই পার?
কোন্ বইটা?
ঐ যে ট্রেনে যেটা পড়ার চেষ্টা করছিলে! মধ্যযুগীয় কী কী সব জিনিসের নান্দনিক ব্যবহার!
ইমতিয়াজ চোখ পাকিয়ে শাহনাজের দিকে তাকাল। রেগে গেলে চোখ থেকে আগুন বের হওয়ার নিয়ম থাকলে শাহনাজ এতক্ষণে পুড়ে কয়লা হয়ে যেত। শাহনাজের ওপর রাগটা ইমতিয়াজ কাজের ছেলেটার ওপর ঝাড়ল, বলল, তোমাকে বলেছিলাম না ঝরনার পানি আনতে, এনেছ?
আপনি বলেছিলেন বিকালবেলা যেতে।
মুখে মুখে তর্ক করছ কেন? এখন গিয়ে নিয়ে আসছ না কেন?
কাজের ছেলেটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, রান্না করেই যাব।
হ্যাঁ। আর আমার জন্য আরো এক কাপ চা দেবে। কনডেন্স মিল্ক দিয়ে।
.
বিকালবেলা তিনটি ভিন্ন খবর পাওয়া গেল। প্রথম খবরটি হল, খবরের কাগজের সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় ইমতিয়াজের যে পোস্ট মডার্ন কবিতাটা ছাপা হওয়ার কথা ছিল সেটা ছাপা হয় নি। পুরো ব্যাপারটা যে পত্রিকার লোকজনের এক ধরনের ঈর্ষা সেটা নিয়ে ইমতিয়াজ বেশি চেঁচামেচি করতে পারল না। কারণ এই বিষয়ে তার চেঁচামেচি শোনার কোনো মানুষ নেই। শাহনাজকে শুনিয়ে কোনো লাভ নেই, কারণ ইমতিয়াজ চেষ্টা করলে সে ঠোঁটের এক কোনা উপরে তুলে ইমতিয়াজ থেকে শেখা বিচিত্র হাসিটি হাসতে থাকে। এবং সেটি দেখে ইমতিয়াজ চিড়বিড় করে জ্বলতে থাকে।
দ্বিতীয় খবরটি সোমাকে নিয়ে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, ডাক্তারেরা। পরীক্ষা করছে। সমস্যাটা কী বোঝার চেষ্টা করছে। সোমার অবস্থা একটু ভালো, সেই ভয়ঙ্কর ব্যথাটি আর হয় নি।
তৃতীয় খবরটির মাথামুণ্ডু বিশেষ বোঝা গেল না। কাজের ছেলেটি বালতি নিয়ে ঝরনার পানি আনতে গিয়ে ফিরে এসেছে, ঝরনা যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। শুনে ইমতিয়াজ শুধু তেলে–বেগুনে নয় তেলে–মরিচে জ্বলতে থাকে। মুখ খিঁচিয়ে বলল, ঝরনা কি রসগোল্লার টুকরা যে কেউ তুলে নিয়ে গেছে?
কাজের ছেলেটা মাথা চুলকে বলল, সেটা তো জানি না, কিন্তু স্যার ঝরনাটা নাই।
সেখানে কী আছে?
আছে স্যার, সবকিছুই আছে, খালি ঝরনাটা নাই।
ইমতিয়াজ খুব রেগেমেগে বলল, আমার সাথে রং তামাশা কর? সবকিছু আছে আর ঝরনাটা নাই মানে? ঝরনার পানি শুকিয়ে গেছে?
জি না। পানি শুকায় নাই। পানি আছে।
পানি আছে তা হলে ঝরনা নাই মানে? ইমতিয়াজ খুব রেগে উঠে বলল, পানি কি তা হলে আসমানে উঠে যাচ্ছে?
কাজের ছেলেটা চিন্তিতভাবে বলল, মনে হয় সেরকমই।
নেহায়েত সোমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে, তা না হলে ইমতিয়াজ নিশ্চয়ই কাজের ছেলেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিছু একটা কাণ্ড করে ফেলত।