ছেলেটা তার জুতোর বাক্স তুলে একটা সুইচ টিপে বলল, আমার সিকিউরিটি আবার অন করে দিলাম।
কী হয় সিকিউরিটি অন করলে?
কেউ ল্যাবরেটরির কাছে এলেই আমি বুঝতে পারি।
কীভাবে তৈরি করেছ সিকিউরিটি?
ছেলেটার মুখে এইবারে স্পষ্ট একটা গর্বের ছাপ ফুটে উঠল, লেজার লাইট দিয়ে। ঐ দেখ রেইনট্রি গাছে লেজার ডায়োড লাগানো আলোটা আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে গাছকে ঘিরে রেখেছে। একটা ফটো–ডায়োড আছে, সার্কিট ব্রেক হলেই আমার সাইরেন চালু হয়ে যায়। এফ, এম, সার্কিট।
শাহনাজ একটু চমকৃত হয়ে ছেলেটার দিকে তাকাল, ইতস্তত করে বলল, কোথায় পেয়েছ এই সিকিউরিটি সার্কিট?
আমি তৈরি করেছি।
শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি তৈরি করেছ!
হ্যাঁ।
তুমি দেখি বড় সায়েন্টিস্ট।
ছেলেটি খুব আপত্তি করল না, মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল। শাহনাজ একটু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোর নাম কী?
ক্যাপ্টেন ডাবলু।
ক্যাপ্টেন কী?
ক্যাপ্টেন ডাবলু। ইউ ভি ডাবলু। সেই ডাবলু।
০৩. ক্যাপ্টেন ডাবলুর সাথে পরিচয়
ক্যাপ্টেন ডাবলুর সাথে পরিচয় হবার দশ মিনিটের মাঝে শাহনাজ বুঝতে পারল এই ছেলেটার মতো আজব ছেলে সে আগে কখনো দেখে নি এবং ভবিষ্যতেও দেখবে না। নিজের নাম বলার পর শাহনাজ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ক্যাপ্টেন ডাবলু কীরকম নাম?
ছেলেটা মনে হয় তার প্রশ্নটাই বুঝতে পারল না, বলল, যেরকম সবার নাম হয় সেরকম নাম।
নামটা কে রেখেছে?
আমিই রেখেছি। শাহনাজের মুখে অবাক হওয়ার চিহ্ন দেখে মনে হয় সে গরম হয়ে উঠল, বলল, কেন? মানুষ কি নিজের নাম নিজে রাখতে পারে না?
নিশ্চয়ই পারে, তবে সাধারণত রাখে না।
আমি রেখেছি। আমার ভালো নাম ওয়াহিদুল ইসলাম। ওয়াহিদু–ল–নামটা বেশি লম্বা। আমার পছন্দ হয় নাই। তাই শুধু সামনের অংশটা রেখেছি। ডাবলু দিয়ে শুরু তো, তাই শুধু ডাবলু। শর্টকাট।
পুরো ব্যাপারটা একেবারে পানির মতো বুঝে ফেলেছে এ রকম ভান করে শাহনাজ জোরে জোরে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু নামের আগে ক্যাপ্টেন কেন?
ছেলেটা দাঁত বের করে হেসে বলল, এইটা নাম না, টাইটেল।
কে দিয়েছে?
কে আবার দেবে? আমিই দিয়েছি। শুনতে ভালো লাগে।
একেবারে অকাট্য যুক্তি, শাহনাজের আর কিছুই বলার থাকল না। ক্যাপ্টেন ডাবলু নামের ছেলেটা শাহনাজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার নাম কী?
শাহনাজ।
শাহনাজ! ছেলেটা মুখ সুচালো করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে বলল, কী অদ্ভুত নাম!
শাহনাজ আপত্তি করে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। যে নিজের নাম শর্টকাট করে ক্যাপ্টেন ডাবলু করে ফেলেছে, তার সাথে নামের গঠন নিয়ে আলোচনা করা মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা উঁচিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে শাহনাজকে জিজ্ঞেস করল, শাহনাজ, তুমি কোথা থেকে এসেছ?
শাহনাজের এবারে একটু মেজাজ গরম হল, তার থেকে বয়সে কমপক্ষে দুই–তিন বছর ছোট হয়ে তাকে নাম ধরে ডাকছে মানে? সে কঠিন গলায় বলল, আমাকে নাম ধরে ডাকছ কেন? আমি তোমার বড় না?
ক্যাপ্টেন ডাবলু অবাক হয়ে বলল, তা হলে কী বলে ডাকব?
শাহনাজ আপু বলে ডাকবে।
ও। শাহনাজ আপু, তুমি কোথা থেকে এসেছ?
ঢাকা থেকে।
কোথায় এসেছ?
সোমা আপুদের বাসায়।
সোমা আপু? সেটা কে?
শাহনাজ একটু অবাক হল, তার ধারণা ছিল চা–বাগানে মানুষজন এত কম যে সবাই বুঝি সবাইকে খুব ভালো করে চেনে। ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে বলল, চা–বাগানের ম্যানেজারের মেয়ে।
ও, বুঝেছি! কী–মজা–হবে আপু।
কী–মজা–হবে আপু?
হ্যাঁ, আমি ঐ আপুকে ডাকি কী–মজা–হবে আপু! যেটাই হয় সেটাতেই ঐ আপু বলে কী–মজা–হবে, সেজন্যে।
শাহনাজের মনে মনে স্বীকার করতেই হল সোমার জন্য এই নামটি একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। সোমার কথা মনে পড়তেই শাহনাজের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। আহা। বেচারি! হাসপাতালে না জানি কীভাবে আছে। ক্যাপ্টেন ডাবলু বুঝতে না পারে সেভাবে খুব। সাবধানে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক্যাপ্টেন ডাবলু আবার বাইরে তাকিয়ে বলল, কী মজা–হবে আপু অনেকদিন এখানে আসে না।
শাহনাজ একটু অবাক হয়ে বলল, আমি ভেবেছিলাম তোমার এটা টপ সিক্রেট।
হ্যাঁ। সেটা সত্যি, কিন্তু কী–মজা–হবে আপু মাঝে মাঝে দেখতে আসত।
ক্যাপ্টেন ডাবলুর কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ আবার তীক্ষ্ণস্বরে পো পো
করে সাইরেনের মতো শব্দ হতে শুরু করে। শাহনাজ চমকে উঠে বলল, ওটা কিসের শব্দ?
ক্যাপ্টেন ডাবলু লাফিয়ে উঠে বাইরে তাকিয়ে বলল, ঐ যে দুষ্টু ছেলেটা এসেছে। নাম হচ্ছে লাল্ট প্রত্যেকদিন একবার আমার লেজার লাইটের সার্কিট হাত দিয়ে ডিস্টার্ব করে।
শাহনাজ লান্টুর নামের দুষ্ট ছেলেটাকে দেখতে পেল। খালি পা এবং শার্টের বোতাম খোলা সাত–আট বছরের একটা ছেলে। হাত দিয়ে ডায়োড লেজারের আলোটা আটকে রেখে মহানন্দে হিহি করে হাসছে। ক্যাপ্টেন ডাবলু গাছের উপরে লাফাতে লাফাতে বলল, খবরদার লা–একেবারে খুন করে ফেলব কিন্তু, লাইট আটকে রাখলে একেবারে দশ হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক শক দিয়ে দেব কিন্তু।
দশ হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক শক দেওয়ার ভয় দেখাতে যেটুকু রাগারাগি করা দরকার, ক্যাপ্টেন ডাবলুর মাঝে মোটেও সেরকম রাগ দেখা গেল না এবং শার্টের বোতাম খুলে পেট বের করে রাখা লাল্টকেও সেই ব্যাপারটি নিয়ে খুব ভয় পেতে দেখা গেল না। বরং দুজনকেই খুব আনন্দ পেতে দেখা গেল এবং শাহনাজ হঠাৎ করে বুঝতে পারল এটি আসলে দুজনের এক ধরনের খেলা। সে মুচকি হেসে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে জিজ্ঞেস করল, কত জন তোমার এই টপ সিক্রেট ল্যাবরেটরির কথা জানে?