বাইরে এসে বারান্দায় বসে শাহনাজ নিজের চোখ মুছে নেয়, তার এত মন–খারাপ লাগছে যে সেটি আর বলার মতো নয়। পরীক্ষা শেষ হবার পর এখানে বেড়াতে এসে সে কত আনন্দ করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল অথচ এখন আনন্দ দূরে থাকুক, পুরো সময়টা যেন একটা বিভীষিকার মতো হয়ে যাচ্ছে। ইমতিয়াজ মনে হয় তার জীবনটাকে একেবারে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। মানুষেরা তাদের ছোটবোনকে কত ভালবাসে কিন্তু ইমতিয়াজকে দেখলে মনে হয়। শাহনাজ যেন ছোটবোন না, সে যেন রাজনৈতিক দলের বিপক্ষ পার্টির নেতা!
শাহনাজ একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। আজ সকালে কাছাকাছি একটা টিলাতে সোমাকে নিয়ে হেঁটে যাবার কথা ছিল। সোমা এখন নেই সে একাই হেঁটে আসবে। সোমা বলেছে পুরো এলাকাটা খুব নিরাপদ, একা একা ঘুরে বেড়াতে কোনো ভয় নেই। শাহনাজ গেট খুলে বের হবার সময় দারোয়ার্ম জানতে চাইল সে কোথায় যাচ্ছে, সঙ্গে কাউকে দেবে কি না। শাহনাজ বলল কোনো প্রয়োজন নেই, সে একাই হেঁটে আসবে।
সোমাদের বাসা থেকে খোয়া–বাঁধানো একটা রাস্তা ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে গেছে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় মেহগনি গাছ। গাছে নানারকম পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। শাহনাজ রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে নিচে নেমে আসে। কাছাকাছি আরো কয়েকটা সুন্দর সুন্দর ছবির মতো বাসা। তার পাশ দিয়ে হেঁটে সে পিছনে টিলার দিকে হাঁটতে থাকে। চা বাগানের শ্রমিক পুরুষ আর মেয়েরা গল্প করতে করতে কাজে যাচ্ছে, শাহনাজ তাদের পিছু পিছু যেতে থাকে। খানিকদূর যাবার পর পায়েচলা পথ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সবাই একদিকে চলে যায়, শাহনাজ অন্যদিকে হাঁটতে থাকে। তার মনটি খুব বিক্ষিপ্ত, কোনোকিছুতেই মন দিতে পারছে না। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটা জংলা জায়গায় হাজির হল, শুকনো পাতা মাড়িয়ে সে একটা বড় গাছের দিকে হেঁটে যেতে থাকে, গাছের গুঁড়িতে বসে বসে সে খানিকক্ষণ নিজের আর সোমার ভাগ্য নিয়ে চিন্তা করবে।
গাছটার কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে প্রায় সাইরেনের মতো তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বেজে ওঠে। শাহনাজ চমকে উঠে একলাফে পিছনে সরে যায়, কিন্তু পো পো শব্দে সেই তীক্ষ্ণ শব্দের মতো সাইরেন বাজতেই থাকে। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝার জন্য শাহনাজ এদিক–সেদিক তাকাতে থাকে, ঠিক তখন বাচ্চার গলায় কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে, খবরদার, কাছে আসবে না।
কথাটি কে বলছে দেখার জন্য শাহনাজ এদিক–সেদিক তাকাল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। শাহনাজ তখন ভয়ে ভয়ে বলল, কে?
আমি।
গলার স্বরটি এল গাছের উপর থেকে এবং শাহনাজ তখন উপরের দিকে তাকাল। দেখল গাছের মাঝামাঝি জায়গায় তিনটি ডাল বের হয়ে এসেছে, সেখানে একটা ছোট ঘরের মতন। সেই ঘরের উপর থেকে দশ–বারো বছরের একটা বাচ্চার মাথা উঁকি দিচ্ছে। বাচ্চাটির বড় বড় চোখ, ভারী চশমা দিয়েও চোখ দুটোকে ছোট করা যায় নি, খরগোশের মতো বড় বড় কান। মাথায় এলোমেলো চুল। বাচ্চাটি সাবধানে আরো একটু বের হয়ে এল। শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি গাছের উপরে কী করছ?
সাইরেনের মতো কর্কশ পো পো শব্দের কারণে ছেলেটি শাহনাজের কথা শুনতে পেল না, সে ভুরু কুঁচকে বলল, কী বলছ?
শাহনাজ আরো গলা উঁচিয়ে বলল, তুমি গাছের উপরে কী করছ?
দাঁড়াও শুনতে পাচ্ছি না বলে বড় বড় কান এবং বড় বড় চোখের ছেলেটা তার হাতে ধরে রাখা জুতার বাক্সের মতো একটা বাক্সের গায়ে লাগানো একটা সুইচ অফ করে দিল, সাথে সাথে কর্কশ এবং তীক্ষ্ণ সাইরেনের মতো পোঁ পোঁ শব্দটি থেমে যায়। ছেলেটি এবারে একটু এগিয়ে এসে বলল, কী বলছ?
শাহনাজ খানিকক্ষণ এই বিচিত্র ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি বলছি তুমি এই গাছের উপর বসে কী করছ?
ছেলেটা ঘাড়টা বাঁকা করে বলল, সেটা বলা যাবে না।
কেন?
কারণ এইটা টপ সিক্রেট। এইটা আমার গোপন ল্যাবরেটরি– বলেই ছেলেটা জিভে কামড় দিল, তার এই তথ্যটাও নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার কথা ছিল না।
শাহনাজ খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি তা বলেই দিলে।
ছেলেটাকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, শঙ্কিতমুখে বলল, তুমি কাউকে বলে দেবে না তো?
শাহনাজ মাথা নাড়ল, বলল, না।
ঠিক তো?
ঠিক।
তা হলে তুমি উপরে আস।
শাহনাজ ভুরু কুঁচকে গাছের উপরে তাকাল, বলল, কেমন করে আসব?
ছেলেটা তার ছোট ঘরটার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং পরের মুহূর্তে একপাশ থেকে দড়ির একটা মই নামিয়ে দিল। ক্যাটক্যাটে গোলাপি হাওয়াই মিঠাই রঙের দুটি নাইলনের দড়ির সাথে বাঁশের কঞ্চি বেঁধে চমৎকার একটা মই তৈরি করা হয়েছে। ছেলেটা গাছের উপরে বসেই মইয়ের নিচের অংশটুকু গাছের নিচে লাগানো একটা আংটায় বাধিয়ে নিল, যেন উপরে ওঠার সময় সেটা দুলতে না থাকে।
শাহনাজ মইয়ে পা দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল, ছিড়ে যাবে না তো?
নাইলন এত সহজে ছেড়ে না। ছেলেটা বড় মানুষের মতো বলল, তোমার ওজন দুইটা দড়িতে ভাগ হয়ে যাবে, এক একটা দড়ি কমপক্ষে দুই শ কিলোগ্রাম নিতে পারবে। আমি টেস্ট করেছি।
শাহনাজ আর তর্ক করল না, দড়ির মইয়ে পা দিয়ে বেশ সহজেই উপরে উঠে আসে। ছেলেটা শেষ অংশে হাত ধরে তাকে সাহায্য করল। উপরে বেশ চমৎকার একটা ঘরের মতো, বাইরে থেকে কাঠকুটো এবং গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে রেখেছে বলে হঠাৎ করে চোখে পড়ে না। ভিতরে অনেকখানি জায়গা এবং সেখানে রাজ্যের যন্ত্রপাতিতে বোঝাই। ছেলেটি বলে না দিলেও একবার দেখলে এটা যে একটা গোপন ল্যাবরেটরি সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকবে না।