শাহনাজের ইচ্ছে করল ইমতিয়াজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে একটা কাণ্ড করে দেয়, কিন্তু সে কিছুই করল না। আস্তে আস্তে বলল, সবাই তো আর আমার মতো হলে চলবে না, আমাদেরও তো ঠ্যাঙ্গানি দেওয়ার জন্য তোমার মতো লুতুপুতু এক–দুইটা মানুষ দরকার।
ইমতিয়াজ চোখ বাঁকিয়ে বলল, কী বললি? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!
শাহনাজ না–শোনার ভান করে বলল, যত হম্বিতম্বি আমার ওপরে! বিলকিস আপু যখন শাহবাগের মোড়ে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে–
ইমতিয়াজ আরেকটু হলে শাহনাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, কোনোমতে সে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। শুনতে পেল বাইরে থেকে ইমতিয়াজ চিৎকার করে বলল, বেয়াদপ পাজি মেয়ে, কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।
শাহনাজ ঘরে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইমতিয়াজ আর বিলকিস এক ক্লাসে পড়ে, দুজনে খুব ভাব, কিন্তু ইমতিয়াজ মনে হয় বিলকিসকে একটু ভয়ই পায়। ইমতিয়াজকে শায়েস্তা করার এই একটা উপায়, বিলকিসকে নিয়ে একটা খোটা দেওয়া। কিন্তু একবার খোটা দিলে তার ঝাল সহ্য করতে হয় অনেকদিন।
আব্বা এলেন সন্ধেবেলা এবং তখন শাহনাজের সারা দিনের রাগ শেষ পর্যন্ত ধুয়েমুছে গেল। আম্মা এবং ইমতিয়াজের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনিয়েও আবাকে ঘাবড়ে দেওয়া গেল না। অট্টহাসি দিয়ে বললেন, শাহনাজ মা, তুই নাকি গুণ্ডী হয়ে যাচ্ছিস?
শাহনাজ মুখ গম্ভীর রেখে বলল, আব্বা এইটা ঠাট্টার ব্যাপার না।
কোনটা ঠাট্টার ব্যাপার না?
এই যে আমার নাকে ঘুসি মেরেছে।
কে বলেছে এইটা ঠাট্টার ব্যাপার? আমি কি বলেছি?
তা হলে হাসছ কেন?
হাসছি? আমি? আমি মোটেই হাসছি না– এই বলে আবা আবার হা হা করে হাসতে লাগলেন।
শাহনাজ খুব রাগ হওয়ার চেষ্টা করেও মোটেও রাগতে পারল না। তবুও খুব চেষ্টা করে চোখেমুখে রাগের একটা চিহ্ন ফুটিয়ে বলল, আব্বা, কাউকে মারলে তার ব্যথা লাগে, তখন সেটা নিয়ে হাসতে হয় না।
আব্বা সাথে সাথে মুখ গম্ভীর করে শাহনাজের গালে হাত বুলিয়ে ছোট বাচ্চাদের যেভাবে আদর করে সেভাবে আদর করে দিলেন। শাহনাজ কোনোভাবে আবার হাত থেকে ছুটে বের হয়ে এল। ভাগ্যিস আশপাশে কেউ নেই। যদি তার বান্ধবীরা কেউ দেখে ফেলত তার মতো এতবড় একজন মেয়েকে তার বাবা মুখটা সুচালো করে কিচি কিচি কু কুচি কুচি কু বলে আদর করে দিচ্ছে তা হলে সে লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারত না। আব্বা বললেন, তোর ব্যথা লাগছে বলে আমি হাসছি না রে পাগলী, আমি হাসছি ঘটনাটা চিন্তা করে। একটা মেয়ে পাই পাই করে আরেকজনের উপরে ঘুসি চালাচ্ছে এটা একটা বিপ্লব না?
বিপ্লব?
হ্যাঁ। আমরা যখন ছোট তখন ছেলেরা মারপিট করলে সেটা দেখেই এক–দুইজন মেয়ের দাঁতকপাটি লেগে যেত।
আম্মা আবার কথাবার্তা শুনে খুব বিরক্ত হলেন। একটা মেয়ে এ রকম মারপিট করে এসেছে, কোথায় তাকে আচ্ছা করে বকে দেবে তা নয়, তাকে এভাবে প্রশ্রয় দিয়ে মাথাটা পুরোপুরি খেয়ে ফেলছেন। আম্মা রাগ হয়ে আব্বাকে বললেন, তোমার হয়েছেটা কী? মেয়েটাকে এভাবে লাই দিয়ে তো মাথায় তুলেছ। এই রাজকুমারী বড় হলে অবস্থাটা কী হবে চিন্তা করেছ?
আব্বা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, রাজকুমারী বড় হলে রাজরানী হবে, এর মাঝে আবার চিন্তা করার কী আছে?
আম্মা একেবারে হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে নাড়তে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আব্বা আবার শাহনাজকে কাছে টেনে এনে বললেন, আমার রাজকুমারী শাহনাজ, বাবা তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
শাহনাজ মুখে রহস্যের ভাব করে বলল, শেষ হয়েছে।
ভালোভাবে শেষ হয়েছে নাকি খারাপভাবে?
তোমার কী মনে হয় আব্বু?
নিশ্চয়ই ভালোভাবে।
শাহনাজ মাথা নেড়ে বলল, আব্বু, আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছে, এখন তুমি আমাকে কী দেবে?
আব্বা মুখ গম্ভীর করে বললেন, তোর এই মোটা নাকে চেপে ধরার জন্য একটা আইসব্যাগ।
যাও! শাহনাজ তার আব্বাকে একটা ছোট ধাক্কা দিল। আব্বা নিজেকে রক্ষা করার জন্য হাত তুলে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোর এই বিশাল নাকের জন্য একটা বিশাল নাকফুল।
এবারে শাহনাজ সত্যি সত্যি রাগ করল, বলল, যাও আব্বু। তোমার সবকিছু নিয়ে শুধু ঠাট্টা।
আব্বা এবারে মুখ গম্ভীর করে বললেন, ঠিক আছে মা, বল তুই কী চাস?
যা চাই তাই দিবে?
সেটা নির্ভর করে তুই কী চাস। এখন যদি বলিস লিওনার্দো দ্য কাপ্রিওকে এনে দাও, তা হলে তো পারব না!
না সেটা বলব না।
তা হলে বল্।
শাহনাজ চোখ ছোট ছোট করে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমি সোমা আপুদের বাগানে বেড়াতে যেতে চাই।
আব্বা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হাত নেড়ে বললেন, তথাস্তু।