প্রথমত মেয়েদের মেয়েলোক বলা এক ধরনের অপমানসূচক কথা, দ্বিতীয়ত শাহনাজ মোটেও মারামারি করে নি, তৃতীয়ত মারামারি করা যদি খারাপ হয় তা হলে সেটা স্কুলের ভিতরে যতটুকু খারাপ, বাইরেও ঠিক ততটুকু খারাপ। এই মুহূর্তে অবশ্য সেটা নিয়ে আলাপ–আলোচনার কোনো সুযোগ নেই, কারণ মোবারক স্যার বিচার শেষ করে সরাসরি শাস্তি–পর্যায়ে চলে গেলেন। নাক ফুলিয়ে চোখ লাল করে দাঁত বের করে হিংস্র গলায় বলতে লাগলেন, তবে রে বদমাইশ মেয়ে, তোর মতো পাজি হতচ্ছাড়া বেজন্মা মেয়ের জন্য দেশের এই অবস্থা। মেয়েলোক হয়ে যদি স্কুলের কম্পাউন্ডে স্যারদের সামনে মারামারি করিস তা হলে বাইরে কী করবি? রাস্তাঘাটে ছিনতাই করবি? মদ গাঞ্জা ফেনসিডিল খেয়ে মানুষের মুখে এসিড মারবি? বাসের ভিতরে পেট্রোলবোমা মারবি? …ভাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর…
শাহনাজ নাক চেপে ধরে বড় বড় চোখ করে মোবারক ওরফে মোরব্বা স্যারের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনতে লাগল। ভ্যাগ্যিস স্যারের গালিগালাজ একটু পরে আর শোনা যায় না, পুরোটাকে একটা টানা লম্বা ভ্যাদর–ভ্যাদর জাতীয় প্রলাপ বলে মনে হতে থাকে!
.
শাহনাজ যখন বাসায় ফিরে এল ততক্ষণে খবর ছড়িয়ে গেছে। আম্মা তার দিকে তাকিয়ে সরু চোখে বললেন, স্কুলে নাকি মারামারি করেছিস?
আমি করি নাই।
আম্মা শাহনাজের লাল হয়ে ফুলে ওঠা নাকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে?
শাহনাজ শীতল গলায় বলল, তা হলে কী?
তোর এইরম চেহারা কেন?
শাহনাজ নাকের ওপর হাত বুলিয়ে বলল, ঝিনু–গুণ্ডী আমাকে ঘুসি মেরেছে।
আম্মা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাহনাজ যদি বলত ঝিনু তাকে খামচি মেরেছে কিংবা চুল টেনেছে, চিমটি দিয়েছে তা হলে আম্মা বিশ্বাস করতেন, একটা মেয়ে যে অন্য একটা মেয়েকে ঘুসি মারতে পারে সেটা আম্মারা এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না। আজকালকার মেয়েরা যে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পকেটমার পর্যন্ত সবকিছু হতে পারে সেটা দেখেও মনে হয় তাদের বিশ্বাস হয় না। আম্মা কাঁপা গলায় বললেন, ঘুসি মেরেছে?
হ্যাঁ।
এত মানুষ থাকতে তোকে কেন ঘুসি মারল?
কারণ আমি মিনমিনে মীনাকে যেতে দেই নাই।
কোথায় যেতে দিস নাই?
শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি এটা বুঝবে না আম্মা। যদি বোঝানোর চেষ্টা করি তুমি বিশ্বাস করবে না।
আম্মা নিশ্বাস আটকে রেখে বললেন, কেন বিশ্বাস করব না?
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হলে তোমার পুরো ইতিহাস জানতে হবে। শুরু করতে হবে। আজ থেকে তিন বছর আগের ঘটনা দিয়ে।
আম্মা এবারে রেগে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, স্কুলে মারামারি করে এসে আবার বড় বড় কথা? স্কুলে পাঠানোই ভুল হয়েছে। রান্না, সেলাই আর বাসন ধোয়ানো শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। শাশুড়ির খন্তার বাড়ি খেয়ে এতদিন সোজা হয়ে যেত।
শাহনাজ পাথরের মতো মুখ করে বলল, এসব দিন ফিনিস। শাশুড়ি খন্তা দিয়ে বাড়ি দিলে তার হাত মুচড়ে সকেট থেকে আলাদা করে নেব।
আম্মা হায় হায় করে মাথায় থাবা দিয়ে বললেন, ও মা গো! কী বেহায়া মেয়ে পেটে ধরেছি গো। কী বলে এই সব!
.
সন্ধেবেলা শাহনাজের বড়ভাই ইমতিয়াজ এসে পুরো ব্যাপারটা আবার গোড়া থেকে শুরু করল। ইমতিয়াজ ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, এবং তার ধারণা সে খুব উঁচু ধরনের মানুষ। ঘর থেকে বের হবার আগে আধাঘণ্টা সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলকে ঠিকভাবে উষ্কখুষ্ক করে নেয়। শাহনাজের সাথে এমনিতে সে বেশি কথা বলে না, যখন তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে হয় কিংবা টিটকারি করতে হয় শুধু তখন সে কথাবার্তা বলে। আজকে শাহনাজকে দেখে সে জোর করে মুখে এক ধরনের ফিচলে ধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, তোর নাকটা দেখেছিস? এমনিতেই নিয়েন্ডারথল মানুষের মতো ছিল, এখন মনে হচ্ছে উপর দিয়ে একটা দোতলা বাস চলে গিয়েছে। হা হা হা।
এই হচ্ছে ইমতিয়াজ। পৃথিবীতে নাক চ্যাপ্টা মানুষ অনেক আছে কিন্তু সে উদাহরণ দেবার সময় এমন একটা শব্দ উচ্চারণ করল যেটা উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যায়। আর। শাহনাজের নাক মোটেও চ্যাপ্টা নয়। তা ছাড়া নাক চাপা হলেই মানুষ মোটেও অসুন্দর হয় না। তাদের ক্লাসে একজন চাকমা মেয়ে পড়ে, নাকটা একটু চাপা কিন্তু দেখতে এত সুন্দর। যে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। শাহনাজ দাঁতে দাঁত চেপে ইমতিয়াজের টিটকারিটা সহ্য করে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চোখের দৃষ্টি দিয়ে কাউকে ভস্ম করা হলে এতক্ষণে ইমতিয়াজ ভুনা কাবাব হয়ে যেত।
ইমতিয়াজ চোখেমুখে একটা উদাস উদাস ভাব ফুটিয়ে মুখের এক কোনায় ঠোঁট দুটোকে একটু উপরে তুলে বিচিত্র একটা হাসি হেসে বলল, তুই নাকি আজকাল রাস্তাঘাটে মারপিট করিস?।
শাহনাজ কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ গলার স্বরে খুব একটা আন্তরিক ভাব। ফুটিয়ে বলল, চাদাবাজিও শুরু করে দিয়েছিস নাকি?
শাহনাজ নিশ্বাস আটকে রাখল, তখনো কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ তখন উপদেশ দেবার ভঙ্গি করে বলল, যখন তুই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবি তখন তোর কোনো চিন্তা থাকবে না! হলে ফ্রি খাবিদাবি। কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে চাঁদা নিবি। বেআইনি অস্ত্র নিয়ে ছেলেপিলেদের ধামকি–ধুমকি দিবি। আর একবার যদি জেলের ভাত খেতে পারিস দেখবি ধাঁধা করে উঠে যাবি। মহিলা সন্ত্রাসী! শহরের যত গডফাদার তোকে ডাবল টাকা দিয়ে ভাড়া করে নিয়ে যাবে!