মিনু হেঁটে হেঁটে একেবারে শাহনাজের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ওঠ।
শাহনাজ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন?
কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলব।
শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, কী করবি?
ঢেলা মেরে কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা গুঁড়ো গুঁড়া করে ফেলব, তারপর আগুন ধরিয়ে দেব।
শাহনাজ সরু চোখে ঝিনুর দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি কথা বলতে কী, তার কথা শুনে সে খুব বেশি অবাক হল না। যে স্যার তাদের কেমিস্ট্রি পড়ান তার নাম মোবারক আলী। মোবারক স্যার ক্লাসে কিছু পড়ান না, শুধু গালিগালাজ করেন, সবাইকে একরকম বাধ্য করেন তার কাছে প্রাইভেট পড়তে। কেমিষ্ট্রি ক্লাসে এবং এই ল্যাবরেটরিতে তাদের যত যন্ত্রণা সহ্য। করতে হয় তার লিস্টি লিখলে সেটা ডিকশনারির মতো মোটা একটা বই হয়ে যাবে। যদি স্কুলে। একটা গণভোট নেওয়া হয় তা হলে সব মেয়ে একবাক্যে সায় দেবে যে কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা ঢেলা মেরে গুঁড়ো গুড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হোক, যদি সম্ভব হয় তা হলে মোবারক আলী স্যারকে ল্যাবরেটরির ভিতরে রেখে। সব মেয়েরা তাকে আড়ালে মোরব্বা স্যার বলে ডাকে, তিনি দেখতে খানিকটা মোরবার মতো সেটি একটি কারণ এবং মেয়েরা মোরার মতো তাকে কেচে ফেলতে চায় সেটি দ্বিতীয় এবং প্রধান কারণ! এই স্যারকে কেউ দেখতে পারে না বলে কেমিস্ট্রি বিষয়টাকেও কেউ দেখতে পারে না। কে জানে কেমিস্ট্রি বিষয়টা হয়তো আসলে ভালোই। মোবারক স্যার আর কেমিস্ট্রি বিষয়টুকু কেউ দেখতে পারে না বলে পুরো ঝালটুকু কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির উপরে মেটানো তো কাজের কথা নয়। রাগ তো থাকতেই পারে কিন্তু রাগ থাকলেই তো সেই রাগ আর এভাবে মেটানো যায় না।
ঝিনু এগিয়ে এসে শাহনাজের কাঁধ খামচে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে বলল, নে, ওঠ!
শাহনাজ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তোর মাথা খারাপ হয়েছে?
কী বললি? ঝিনু–গুণ্ডী ঠিক গুণ্ডার মতো চেহারা করে বলল, আমার মাথা খারাপ হয়েছে?
হ্যাঁ। তা না হলে কেউ এ রকম করে কথা বলে? জানিস, যদি ধরা পড়িস তা হলে দশ বছরের জন্য তোকে বহিষ্কার করে দেবে?
ধরা পড়ার কথাটি ঝিনুর মাথায় আসে নি, সে চোখ ছোট ছোট করে বলল, ধরা পড়ব কেন? তুই বলে দিবি নাকি??
শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না, ঝিনু আরো এক পা এগিয়ে এসে ঘুসি পাকিয়ে বলল, বলে দেখ, তোর অবস্থা কী করি! এক ঘুসিতে যদি তোর নাকটা আমি ভিতরে ঢুকিয়ে না দিই!
মিনমিনে মীনা আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঝিনু এক ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আর ধরা পড়লেই কী? আর আমাদের স্কুলে আসতে হবে না। শুধু কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি কেন, পুরো স্কুলটাই জ্বালিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।
মিনমিনে মীনা শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলল, পরীক্ষার রেজাল্ট আর টেষ্টিমনিয়াল নিতে আসতে হবে না?
শাহনাজ বলল, আর যদি ফেল করিস?
ঝিনু–গুণ্ডী এত যুক্তিতর্ক পছন্দ করছিল না, মীনাকে ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, আয় যাই। আগে কয়টা ঢেলা নিয়ে আয়।
শাহনাজ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে বলল, যাস নে মীনা। কেউ দেখে ফেললে নালিশ করে দেবে, তখন একেবারে বারোটা বেজে যাবে। সোজা জেলখানায় চলে যাবি।
জেলখানার তয়েই কি না কে জানে, মীনা শেষ পর্যন্ত সাহস করে ঝিনুর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে বলল, আমি যাব না।
ঝিনু চোখ লাল করে দাঁত কিড়মিড় করে নাক দিয়ে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে হুঙ্কার দিয়ে বলল, কী বললি, যাবি না?
মীনা ভয়ের চোটে প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, না।
ঝিনু মীনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, শাহনাজ আর সহ্য করতে পারল না, গলা উচিয়ে বলল, ঝিনু তুই গুণ্ডামি করতে চাস একা একা কর গিয়ে, মীনাকে কেন টানছিস?
কী বললি? ঝিনু কেঁদো বাঘের মতো মুখ করে বলল, কী বললি তুই? আমি গুণ্ডা?
না। আমি তা বলি নাই। আমি বলেছি–
শাহনাজ কী বলেছে সেটা ব্যাখ্যা করার আগেই ঝিনু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নাকের ওপর একটা ঘুসি মেরে বসল। শাহনাজ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, আচমকা ঘুসি খেয়ে সে চোখে অন্ধকার দেখল। দুই হাতে নাক চেপে ধরে সে পিছন দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ঝিনু এগিয়ে এসে চুল ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, আমার সাথে রংবাজি করিস? এমন পেজকি লাগিয়ে দেব যে পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবে। তারপর একটা খারাপ গালি দিয়ে দুই নম্বর ঘূসিটা বসানোর চেষ্টা করল। শাহনাজ এইবার প্রস্তুত ছিল বলে সময়মতো সরে যাওয়াতে ঘুসিটা ঠিক জায়গায় লাগাতে পারল না। মিনমিনে মীনা অবশ্য ততক্ষণে তার খনখনে গলায় এত জোরে চেঁচাতে শুরু করেছে যে তাদের ঘিরে অন্য মেয়েদের ভিড় জমে গেল। সবাই মিলে ঝিনুকে টেনে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেও কোনো সুবিধে করতে পারল, ঝিনু হুঙ্কার দিয়ে বলল, আমার সঙ্গে মস্তানি? পরের বার একেবারে চাকু মেরে দেব!
ঠিক এ রকম সময় কেমিস্ট্রির স্যার মোবারক আলী লম্বা পা ফেলে হাজির হলেন এবং ভিড়টা হালকা হয়ে গেল। ঝিনু অদৃশ্য হল সবার আগে, শাহনাজ তার নাক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল এবং মোবারক আলী ওরফে মোরব্বা স্যার তাকেই প্রধান আসামি বিবেচনা করে বিচারকার্য শুরু করে দিলেন। স্যারের বিচার খুব সহজ, হুঙ্কার দিয়ে বললেন, তোর এতবড় সাহস? মেয়েলোক হয়ে স্কুলের ভিতর মারামারি করিস?