শাহনাজ যখন চোখ খুলে তাকাল তখন তাদের সামনে ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। সে অত্যন্ত সন্দেহের চোখে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোরা এখানে কখন এসেছিস?
শাহনাজ আমতা আমতা করে বলল, এই তো একটু আগে।
ইমতিয়াজ চিন্তিত মুখে বলল, কী একটা ছবি তুলতে এসেছিলাম, মনে করতে পারছি ন্য।
শাহনাজ বলল, মনে হয় এই ঝরনাটার।
ইমতিয়াজ ঘুরে তাকাল, পাহাড়ের উপর থেকে পানির ধারা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটি দেখতে দেখতে বলল, ঝরনার আবার ছবি তোলার আছে? তারপর বিরক্ত মুখে বলল, দে দেখি ক্যামেরাটা, এসেছি যখন একটা ছবি তুলে নিই।
শাহনাজ ক্যামেরাটা এগিয়ে দেয়, হাতে নিয়ে ইমতিয়াজ বিরক্তমুখে বলল, এ কী, একটা ফিল্মও তো বাকি নেই দেখি! কিসের ছবি তুলে ফিল্মটা শেষ করেছিস?
শাহনাজ আমতা আমতা করে বলল এই তো এইসব জিনিসপত্র!
.
বাসায় এসে তারা আবিষ্কার করল সোমা ফিরে এসেছে। শাহনাজকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, জানিস শাহনাজ আমি ভালো হয়ে গেছি। একেবারে ভালো হয়ে গেছি। ডাক্তাররা খুঁজে কোনো সমস্যাই পায় নি!
ইমতিয়াজ মুখ বাঁকা করে বলল, আমি আগেই বলেছিলাম সাইকোসেমেটিক। মানসিক রোগ। এখন আমার কথা বিশ্বাস হল?
সোমার আম্মা বললেন, তুমিই ঠিক বলেছ বাবা, আমরা বুঝতে পারি নি!
সোমা খিলখিল করে হেসে বলল, কী মজা দেখেছ, সাইকোসেমেটিক অসুখ হলে কেমন লাগে সেটাও এখন আমি বুঝে গেলাম।
শাহনাজের ক্যামেরার ফিল্মটি ডেভেলপ করে নিয়ে আসার পর সেখানে মহাকাশযান এবং ডক্টর জিজির অনেক ছবি দেখা গেল। শাহনাজ প্রথমে ছবিগুলো দেখাল সোমাকে। সোমা ছবি দেখে হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল, ওমা! এমন মজার ছবি কোথায় তৈরি করেছিস?
শাহনাজ বলল, আসলে তৈরি করি নি_
সোমা বাধা দিয়ে বলল, বুঝেছি, ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাজ! এইটুকুন ছেলের কী বুদ্ধি কয়দিন আগে আমার একটা ছবির সাথে ডাইনোসরের ছবি জুড়ে দিল। দেখে মনে হয় সত্যি সত্যি ডাইনোসর। কম্পিউটার দিয়ে করে, তাই না?
না, সোমা আপু। এটা সত্যি–
সোমা খিলখিল করে হেসে বলল, তুই যে কী মজা করতে পারিস শাহনাজ, তোকে দেখে অবাক হয়ে যাই! আমারও এ রকম একটা ছবি আছে এলিয়েনের সাথে, কম্পিউটার দিয়ে করা। তোর ছবির এলিয়েনটা দেখ, কেমন জানি বোকা বোকা চেহারা। আমারটা ভয়ঙ্কর দেখতে, এই বড় বড় দাঁত, নাক দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।
শাহনাজ কিছু বলল না, একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল।
.
সোমাদের চা–বাগানে প্রায় একমাস সময় কাটিয়ে শাহনাজ ঢাকায় ফিরে এসেছিল। তার কিছুদিন পর ক্যাপ্টেন ডাবলুর একটা চিঠি এসে হাজির, চিঠিটা শুরু হয়েছে এইভাবে :
প্রিয় পু
আশা করি তুমি ভালো আছ। আমি ভালো নাই। আমি যার কাছেই ডক্টর জিজির কথা বলি, কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। আমার আব্বু সেদিন আমার সায়েন্স ফিকশানের সব বই বাক্সে তালা মেরে বন্ধ করে রেখে দিয়েছেন। এইসব ছাইভস্ম পড়ে পড়ে আমার নাকি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। লান্টু পর্যন্ত আমার কথা বিশ্বাস করে না, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। কী–মজা–হবে আপু আমার যেন মনখারাপ না হয় সেজন্যে ভান করে যে ডক্টর জিজির কথা বিশ্বাস করেছে কিন্তু আসলে করে নাই।
ডক্টর জিজির কথা বিশ্বাস করানোর জন্য কী করা যায় বুঝতে পারছি না। তাড়াতাড়ি চিঠি লিখে জানাও।
ইতি
ক্যাপ্টেন ডাবলু
পুন. তোমাকে শুধু পু ডেকেছি বলে কিছু মনে কর নাই তো?
শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুকে চিঠির উত্তরে কী লিখবে এখনো ভেবে ঠিক করতে পারে নি।
১০. পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে
পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে শাহনাজ হেঁটে হেঁটে স্কুলের এক কোনায় লাইব্রেরি বিল্ডিঙের সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসল। তার পরীক্ষা শেষ, এখন তার মনে খুব আনন্দ হওয়ার কথা। এতদিন যে হাজার হাজার ফরমুলা মুখস্থ করে রেখেছিল এখন সে ইচ্ছে করলে সেগুলো ভুলে যেতে পারে। বড় বড় রচনা, নোট করে রাখা ব্যাখ্যা, গাদা গাদা উপপাদ্য, প্রশ্নের উত্তরের শত শত পৃষ্ঠা মাথার মাঝে জমা করে রেখেছিল; যেগুলো সে পরীক্ষার হলে একটার পর একটা উগলে দিয়ে এসেছে–এখন সে তার সবগুলো মস্তিষ্ক থেকে উধাও করে দেবে, কোনোকিছুই আর মনে রাখতে হবে না–এই ব্যাপারটা চিন্তা করেই আনন্দে তার বুক ফেটে যাবার কথা। শাহনাজ অবশ্য অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার ভিতরে আনন্দ–দুঃখ কিছুই হচ্ছে না, ভিতরটা কীরকম যেন ম্যাদা মেরে আছে! পরীক্ষা শেষ হবার পর যেসব কাজ করবে বলে এতদিন থেকে ঠিক করে রেখেছিল, যে গল্পের বইগুলো পড়বে বলে। জমা করে রেখেছিল তার কোনোটার কথা মনে পড়েই কোনোরকম আনন্দ হচ্ছে না। এ রকম যে হতে পারে সেটা সে একবারও চিন্তা করে নি, কী মন–খারাপ–করা একটা ব্যাপার!
শাহনাজ একটা বিশাল লম্বা নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকাল, তখন দেখতে পেল মীনা আর ঝিনু এদিকে আসছে। মীনা তাদের ক্লাসের শান্তশিষ্ট এবং হাবাগোবা টাইপের মেয়ে, তাই সবাই তাকে ডাকে মিনমিনে মীনা। ঝিনু একেবারে পুরোপরি মীনার উল্টো, সোজা। ভাষায় বলা যায় ডাকাত টাইপের মেয়ে। যদি কোনোভাবে সে কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে পারে তা হলে যে সেখানে সন্ত্রাসী আর চাদাবাজি শুরু করে দেবে সে ব্যাপারে কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই। তাকে সবাই আড়ালে ঝিনু–মস্তান বলে ডাকে এবং ঝিনু মনে হয় ব্যাপারটা বেশ পছন্দই করে। মীনা এবং ঝিনুর একসাথে থাকার কথা নয় এবং দুজনে কাছে এলে বুঝতে পারল ঝিনু মীনাকে ধরে এনেছে। কাঁচপোকা যেভাবে তেলাপোকা ধরে আনে অনেকটা সেরকম ব্যাপার। শাহনাজ দেখল মীনার নাকের মাঝে বিন্দু বিন্দু ঘাম, মুখ রক্তহীন, আতঙ্কিত এবং ফ্যাকাসে।