মস্তানগুলো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না যে এইরকম পুঁচকে একটা মেয়ে তাদেরকে এতটুকু ভয় না পেয়ে এ রকমভাবে তাদের কাছে ছুটে আসছে! রিভলবার হাতে মস্তানটির আর সহ্য হল না, সে তার রিভলবারটি শাহনাজের দিকে তাক করে মুখ খিঁচিয়ে কুৎসিত একটা গালি দিয়ে গুলি করে বসল। গুলোটা অদৃশ্য একটা দেয়ালে আঘাত করে তাদের দিকে ফিরে গেল—-সেটা অবশ্য উত্তেজনার কারণে মস্তানেরা টের পেল না।
শাহনাজ মস্তানগুলোর কাছে এসে নিজের দুই হাতের তর্জনী বের করে ছোট বাচ্চারা যেভাবে রিভলবার তৈরি করে খেলে সেভাবে খেলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল, এই যে ছারপোকার বাচ্চারা–ভেবেছিস শুধু তোর রিভলবার আছে, আমার নেই? এই দ্যাখ আমার দুই রিভলবার, গুলি করে বারটা বাজিয়ে দেব কিন্তু।
মস্তানগুলো অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে রইল, এখন তাদের সন্দেহ হতে শুরু করেছে যে মেয়েটি সম্ভবত পাগল। তারা আর সময় নষ্ট করল না, স্কুটারের দিকে ছুটে যেতে শুরু করল। শাহনাজ তখন রিভলবারের ভঙ্গিতে ধরে রাখা তর্জনীটি স্কুটারের দিকে তাক করে বলল, গুলি করলাম কিন্তু, তারপর মুখ দিয়ে শব্দ করল, ডিচুম।
সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে স্কুটারটা মাটি থেকে লাফিয়ে উপরে উঠে গেল। মস্তান তিনটি চমকে উঠে ঘুরে শাহনাজের দিকে তাকায়, এই প্রথমবার তাদের মুখে ভয়ের চিহ্ন ফুটে ওঠে।
শাহনাজ দুই হাতের দুই তর্জনী তাক করে বলল, কী আমার সোনার চানেরা, বিশ্বাস হল যে আমি গুলি করতে পারি? এই দেখ বলে শাহনাজ আবার কাউবয়ের ভঙ্গিতে দুই হাত দিয়ে ডিচুম করে গুলি করতে থাকে, আর কী আশ্চর্য প্রত্যেকবার গুলি করার সাথে স্কুটারটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে।
ঝিনু এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে পুরো ব্যাপারটি দেখছিল, এবার সে পায়ে পায়ে শাহনাজের কাছে এগিয়ে এল। শাহনাজ বলল, হা করে দেখছিস কী? গুলি কর।
ঝিনু বলল, গুলি করব? কীভাবে?
শাহনাজ নিজের হাতকে রিভলবারের মতো করে বলল, এই যে এইভাবে।
তা হলেই গুলি হবে?
হ্যাঁ। এই দেখ– বলে সে আবার ডিচুম ডিচুম করে কয়েকটা গুলি করল। সত্যি সত্যি সাথে সাথে কয়েকটা বিস্ফোরণ হল। ঝিনু অনিশ্চিতের মতো নিজের হাতটাকে রিভলবারের মতো করে স্কুটারের দিকে তাক করে গুলি করার ভঙ্গি করল, সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে স্কুটারটা লাফিয়ে ওঠে। ঝিনু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে একবার নিজের হাতের দিকে, আরেকবার স্কুটারটার দিকে তাকাল সত্যি সত্যি নিজের আঙুল দিয়ে সে গুলি করে ফেলেছে সেটা এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
বিস্ফোরণ এবং গুলির শব্দ শুনে তাদের ঘিরে মানুষের ভিড় জমে গেছে। মস্তানগুলো কী করবে বুঝতে পারছে না, পালিয়ে যাবার জন্য রিভলবার তাক করে একদিকে ছুটে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু অদৃশ্য একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল। তাদেরকে অদৃশ্য একটা দেয়াল ঘিরে রেখেছে সেটা এখনো বুঝতে পারছে না।
শাহনাজ ঝিনুকে বলল, আয় এখন মস্তানগুলোকে বানাই।
ঝিনু তার হাতের অদৃশ্য রিভলবারের দিকে তাকিয়ে বলল, এইটা দিয়ে গুলি করলে মরে যাবে না?
হ্যাঁ। রবার বুলেট দিয়ে করতে হবে।
ঝিনু মুখ হাঁ করে বলল, রবার বুলেট?
হ্যাঁ, এই নে। শাহনাজ ঝিনুর হাতে কাল্পনিক রবার বুলেট ধরিয়ে দেয়। ঝিনু কী করবে বুঝতে পারছিল না। শাহনাজ গম্ভীর গলায় বলল, ভরে নে। তারপর নিজে তার রিভলবারে রবার বুলেট ভরে নেওয়ার ভঙ্গি করে সেটি মস্তানদের দিকে তাক করল, সাথে সাথে মস্তানদের কুৎসিত মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়। শাহনাজ সময় নিয়ে গুলি করল এবং অদৃশ্য গুলির আঘাতে একজন মস্তান নিচে ছিটকে পড়ল। তার মনে হল প্রচও ঘুসিতে কেউ তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। এতক্ষণে ঝিনুও তার অদৃশ্য রিভলবারে অদৃশ্য রবার বুলেট ভরে নিয়েছে, সে দ্বিতীয় মস্তানটির দিকে তাক করতেই মস্তানটি হঠাৎ দুই হাজাড় করে হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়। ঝিনু মস্তানের তবু মায়া হল না, সে অদৃশ্য রিভলবারের ট্রিগার টেনে ধরতেই দ্বিতীয় মস্তানটিও ধরাশায়ী হয়ে গেল। স্কুটারের ড্রাইভার এবং রড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মস্তানটি এখনো নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিল, মজা–দেখা মানুষেরা এখন তাদের দিকে ছুটে আসতে রু করে। শাহনাজ নিচু গলায় বলল, এখন পালা, বাকিটা পাবলিক ফিনিশ করবে।
দাঁড়া, আমার চেনটা নিয়ে নিই শুয়ে কাতরাতে থাকা মস্তানটির কাছে গিয়ে ঝিনু তার মাথায় অদৃশ্য রিভলবার ধরে বলল, আমার চেন।
মস্তানটি কোনো কথা না বলে সাথে সাথে পকেট থেকে তার চেনটা বের করে দিল। ঝিনু চেনটা হাতে নিয়ে শাহনাজকে বলল, চল্। পালাই।
তারপর দুজন ঘুরে ফুটপাত ধরে ছুটতে থাকে। রাস্তার মোড়ে ঘুরে গিয়ে দুজন একটা ছোট গলিতে ঢুকে পড়ে। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে দুজন একটা দেয়ালের পাশে দাঁড়াল। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর জোরে জোরে হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে শাহনাজের চোখে পানি এসে গেল, সে চোখ মুছে ঝিনুকে বলল, এখন বাড়ি যা, ঝিনু মস্তান!
ঝিনু শাহনাজকে ধাক্কা দিয়ে বলল, আমাকে মস্তান বলছিস? তুই হচ্ছিস সবচেয়ে বড় মস্তান!
শাহনাজ কিছু বলল না, চোখ মটকে বলল, আমাকে যেতে হবে।