সার কাঁদো–কাদো গলায় বললেন, সত্যি হবে?
হবে স্যার, চেষ্টা করে দেখেন। শাহনাজ একগাল হেসে বলল, আর যদি সেটা না করতে চান তা হলে ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন, অপারেশন করে ছোট করে দেবে।
স্যার শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নাক মুছতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন এখন আর আগের মতো নাক মুছতে পারছেন না, এবারে শুঁড়ের মতো নাকের ডগা মুছতে হচ্ছে। শাহনাজ ঘরে গাদাগাদি করে বসে থাকা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা স্যারকে সাহায্য কর। একটা বড় লিস্ট করে দাও, স্যার সেই লিস্ট দেখে একটা একটা করে বলবেন। ঠিক আছে?
মেয়েগুলো আনন্দে মুখ ঝলমল করে একসাথে চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে, শাহনাজ আপু।
শাহনাজ মোবারক স্যারের ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই তাকে টুক করে টেনে ডক্টর জিজির ভাসমান যানে তুলে নিল। সেখানে উঠে শাহনাজ দেখতে পেল ক্যাপ্টেন ডাবলু পেটে হাত দিয়ে খিকখিক করে হাসছে এবং ডক্টর জিজি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে আছে। শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
ঐ দেখ।
শাহনাজ দেখতে পেল মোবারক স্যার জবুথবু হয়ে বসে আছেন। মেয়েরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের হাতে একটা রুলার, সে নাকটাকে লম্বা করে টেনে ধরে মাপছে। অন্যেরা একটা লিস্ট তার সামনে ধরে রেখেছে, তিনি একটা একটা করে সেটা পড়ছেন। শাহনাজ দৃশ্যটা দেখে আবার হি হি করে হেসে উঠল। ডক্টর জিজি মাথা নেড়ে বলল, অত্যন্ত বিচিত্র!
সে যন্ত্রপাতিতে হাত দিতেই ভাসমান যানটি মৃদু একটা ভোঁতা শব্দ করে হঠাৎ করে ঘুরে গেল, মুহূর্তে চারদিক ঝাঁপসা হয়ে যায়। শাহনাজ বলল, এখন বাকি আছে শুধু ঝিনু মস্তান। তাকে একটা শিক্ষা দিতে পারলেই কেস কমপ্লিট।
ঝিনু মস্তান? ডক্টর জিজি শাহনাজের মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। এমন টাইট দেব যে সে জন্মের মতো সিধে হয়ে যাবে!
তুমি কি নিশ্চিত যে তাকে তুমি টাইট দিতে চাও?
হ্যাঁ। যেদিন আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছিল সেদিন কী করেছিল জান? ঘুসি মেরে আমার নাকটা চ্যাপ্টা করে দিয়েছিল। মহা গুণ্ডা।
ডক্টর জিজি বলল, তা হলে কি আমি তোমাকে তার কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দেব?
হ্যাঁ। আর মনে আছে তো আমি যেটাই বলব সেটাই করবে।
ঠিক আছে।
শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে বলল, ডাবলু, তুই নামবি এবার?
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, বলল, না। এখান থেকে দেখায় মজা বেশি।
কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে ভাসমান যানটা একটা শব্দ করে থেমে গেল এবং শাহনাজ আবিষ্কার করল সে কাওরানবাজারের কাছাকাছি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর। জিজি তাকে খুব কায়দা করে নামিয়েছে কেউ কিছু সন্দেহ করে নি। কিন্তু ঝিনু মস্তানের কাছে না নামিয়ে তাকে রাস্তায় নামিয়ে দিল কেন কে জানে। ডক্টর জিজি অবশ্য ভুল করার। পাত্র নয়, এই রাস্তার মাঝে নামিয়ে দেবার নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে। শাহনাজ এদিক সেদিক তাকাল এবং হঠাৎ করে ভয়ানকভাবে চমকে উঠল। ফুটপাত থেকে একটু দূরে রাস্তায় একটা রিকশায় ঝিনু মস্তান বসে আছে, তাকে ঘিরে তিনজন সত্যিকারের মস্তান। একজনের হাতে একটা জংধরা রিভলবার, অন্যজনের হাতে একটা বড় চাকু, তিন নম্বর মস্তানের হাতে একটা লোহার রড। কাছেই একটা স্কুটার দাঁড়িয়ে আছে, মস্তানগুলো মনে হয় এই স্কুটার থেকেই নেমেছে। লোহার রড হাতে মস্তানটি তার রড দিয়ে রিকশার সিটে প্রচণ্ড জোরে একটা আঘাত করল, মনে হয় ভয় দেখানোর জন্য। রিভলবার হাতে মস্তানটি তার রিভলবারটি ঝিনু মস্তানের দিকে তাক করে খনখনে গলায় চিৎকার করে বলল, দে ছেমড়ি, গলার চেইনটা দে।
শাহনাজ ঝিনু মস্তানের দিকে তাকাল, ক্লাসে তাকে তারা ঠাট্টা করে মস্তান বলে ডাকত কিন্তু এখন সত্যিকারের মস্তানের সামনে তাকে কী অসহায় লাগছে! ঝিনু তার গলা থেকে চেনটা খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভয়ে তার হাত কাঁপছে বলে খুলতে পারছে না। চাকু হাতে মস্তাটা ক্রমাগত নড়ছে আর চোখের কোনা দিয়ে এদিক–সেদিক তাকাচ্ছে, সে অধৈর্য হয়ে হঠাৎ লাফিয়ে ঝিনুর গলার চেনটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল। চেনটা ছিঁড়ে তার হাতে এসে যায় কিন্তু তাল সামলাতে না পেরে ঝিনু রিকশা থেকে হুমড়ি খেয়ে নিচে এসে পড়ল।
শাহনাজ চারদিকে তাকাল, রিকশাটা ঘিরে দূরে দূরে মানুষজন দেখছে, কেউ ভয়ে কাছে আসছে না। ঝিনু রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে, মুখ বিকৃত করে যন্ত্রণাটা সহ্য করে ওঠার চেষ্টা করছে! মস্তানগুলো এদিক–সেদিক তাকাতে তাকাতে স্কুটারে ওঠার জন্য ছুটতে শুরু করেছে, তখন শাহনাজ ছুটে যেতে শুরু করে। চিৎকার করে বলল, ঐ ঐ মস্তানের বাচ্চা মস্তান, যাস কোথায় পালিয়ে? খবরদার যাবি না।
অন্য যে কেউ এ ধরনের কথা বললে মস্তানরা কী করত জানা নেই, কিন্তু শাহনাজের বয়সী একটা মেয়ের মুখে এ রকম একটা কথা শুনে মস্তানগুলো ঘুরে দাঁড়াল। রিভলবার
হাতে মস্তানটি তার রিভলবার তাক করে বলল, চুপ ছেমড়ি। একেবারে শেষ করে ফেলব।
শাহনাজ চুপ করল না, চিৎকার করতে করতে ঝিনুকে টেনে তুলে বলল, ওঠ ঝিনু, তাড়াতাড়ি ওঠ। এই মস্তানগুলোকে বানাতে হবে।
ঝিনু তখনো কিছু বুঝতে পারছে না, অবাক হয়ে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে আছে। শাহনাজ তখন চিৎকার করতে করতে মস্তানগুলোর দিকে ছুটে যেতে থাকে, খবরদার নড়বি না মস্তানের বাচ্চা মস্তানেরা, শেষ করে ফেলব, খুন করে ফেলব।