হ্যাঁ। মোরব্বা স্যার আছে?
মেয়েটি মুখে আঙুল দিয়ে বলল, শ–স–স–স, স্যার শুনতে পাবে।
শুনলে শুনবে। আমি আর ভয় পাই না। স্যার কোথায়?
ঐ ঘরে, ব্যাচে পড়াচ্ছে আমাদের।
চল যাই, স্যারের সাথে দেখা করতে হবে।
শাহনাজ পাশের ঘরে গিয়ে দেখতে পেল একটা বড় ঘরে অনেকগুলো মেয়ে গাদাগাদি করে বসে আছে, সামনে একটা চেয়ারে পা তুলে কুৎসিত ভঙ্গিতে বসে থেকে একটা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে স্যার নাক খুঁটছে। শাহনাজকে দেখে স্যার ভুরু কুঁচকে বললেন, কে?
আমি স্যার।
মোবারক স্যার খেঁকিয়ে উঠলেন, আমিটা আবার কে?
আমার নাম শাহনাজ। আপনার ছাত্রী।
ও। স্যার নাক খুঁটতে খুঁটতে জিজ্ঞেস করলেন, কী চাস?
অনেক দিন থেকেই আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
কী কথা?
আপনি যে ক্লাসে কিছু পড়ান না, সবাইকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন সেটা খুব অন্যায়।
শাহনাজের কথা শুনে মোবারক স্যারের চোয়াল স্কুলে পড়ল, খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না, মাছকে পানি থেকে ডাঙায় তুললে যেভাবে খাবি খেতে থাকে সেভাবে খাবি খেতে লাগলেন। তারপর নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস বের করে বললেন, কী বললি?
আমি বলেছি যে আপনি যে ক্লাসে কিছু পড়ান না, সবাইকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন সেটা খুব অন্যায়।
মোবারক স্যার যেখানে বসে ছিলেন সেখানেই বসে থেকে কীভাবে যেন লাফিয়ে উঠলেন, উত্তেজনায় তার লুঙ্গি খুলে গেল এবং কোনোভাবে সেই লুঙ্গি ধরে চিৎকার দিয়ে বললেন, তবে রে পাজি মেয়ে। বদমাইশির জায়গা পাস না
অন্য যে কোনো সময় হলে ভয়ে শাহনাজের জান উড়ে যেত, কিন্তু আজ অন্য ব্যাপার, সে ভয় পেল না। বরং মুখটা হাসি–হাসি করে বলল, আপনি আরো বড় বড় অন্যায় কাজ করেন স্যার! পরীক্ষার আগে ছাত্রীদের কাছে থেকে টাকা নিয়ে তাদের পরীক্ষার প্রশ্ন বলে দেন। সেটা আরো বড় অন্যায়।
তবে রে শয়তানী বলে মোবারক স্যার শাহনাজের দিকে একটা লাফ দিলেন। কিন্তু তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার হল, মনে হল মোবারক স্যার অদৃশ্য একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে গেলেন। কোনোমতে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকালেন এবং ঠিক তখন একটা মেয়ে কোথায় জানি হাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে শেষ পর্যন্ত না পেরে ফিচ করে একটু হেসে ফেলল। মোবারক স্যার চারদিকে মুখ ঘুরিয়ে একটা হুংকার দিয়ে বললেন, চোপ, সবাই চোপ!
শাহনাজ নরম গলায় বলল, শব্দটা হচ্ছে চুপ। বাংলায় চোপ বলে কোনো শব্দ নেই।
তবে রে বদমাইশি– বলে মোবারক স্যার শাহনাজের উদ্দেশে আরেকটা লাফ দিলেন, কিন্তু আবার অদৃশ্য দেয়ালে আঘাত খেয়ে নিচে আছাড় খেয়ে পড়লেন। বেশকিছু মেয়ে লাফিয়ে সরে গিয়ে ঠিকভাবে আছাড় খাবার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা করে দিল। শাহনাজ তখন দুই পা অগ্রসর হয়ে বলল, স্যার খামোকা আমাকে ধরার চেষ্টা করবেন না। পারবেন না। এর চাইতে অপরাধ স্বীকার করে ফেলেন।
মোবারক স্যারের কপাল ফুলে উঠেছে, সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে হিংস্র চোখে বললেন, কী বললি তুই?
আমি বলছি যে আপনি যে প্রাইভেট পড়ানোর নাম করে ছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদেরকে পরীক্ষার প্রশ্ন বলে দেন, কিছু শেখান না–সেটা স্বীকার করে নেন।
তুই কে? তোর কাছে কেন আমি স্বীকার করব?
শাহনাজ সব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা সব সাক্ষী। আমি কিন্তু স্যারকে একটা সুযোগ দিয়েছি। দিই নি?
মেয়েরা আনন্দে সবগুলো দাঁত বের করে জোরে জোরে মাথা নাড়ল। শাহনাজ মোবারক স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার এখনো সময় আছে। আপনি যদি অপরাধ স্বীকার করেন, আপনাকে এবারের মতো মাফ করে দেওয়া হবে। আর যদি স্বীকার না করেন, মিথ্যা কথা বলেন, খুব বড় বিপদ হবে।
কতবড় সাহস তোর? আমাকে বিপদের ভয় দেখাস!
জি স্যার। মিথ্যা কথা বললেই আপনার নাকটা এক হাত লম্বা হয়ে যাবে।
মোবারক স্যার চিৎকার করে বললেন, আমি মিথ্যা কথা বলি না। স্যারের কথা শেষ হবার আগেই সড়াৎ করে একটা শব্দ হল আর সবাই অবাক হয়ে দেখল স্যারের নাকটা লম্বা হয়ে পেট পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে। গাদাগাদি করে বসে থাকা মেয়েগুলো ভয় পেয়ে চিৎকার করে সবাই পিছনে সরে এল। শাহনাজ হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, আমি বলছিলাম না? আপনি আমার কথা শুনলেন না!
মোবারক স্যার একেবারে হতভম্ব হয়ে নিজের নাকের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগল একটা সাপ বুঝি নাককে কামড়ে ধরেছে। ভয়ে ভয়ে তিনি লম্বা নাকটা ধরলেন, তারপর একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে সেটাকে খুলে ফেলার চেষ্টা করলেন এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন, সত্যি সত্যি তার নাক লম্বা হয়ে গেছে।
গাদাগাদি করে বসে থাকা মেয়েগুলোর ভিতর থেকে একজন হঠাৎ আবার ফিচ করে হেসে ফেলল। হাসি ভয়ানক সংক্রামক একটি জিনিস, ফিচ শব্দটি শুনে আরো অনেকে ফিচ ফিচ করে হাসতে শুরু করল। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর বেশ জোরে। শাহনাজ অনেকক্ষণ চেষ্টা করে আর নিজেকে সামলাতে পারল না, খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।
মোবারক স্যার নিজের লম্বা নাকটা ধরে হতভম্বের মতো বসে রইলেন, কয়েকবার কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে থেমে গেলেন। শাহনাজ হাসি থামিয়ে বলল, স্যার, আপনি যেসব। অন্যায় করেছেন সেগুলো একটা একটা করে বলতে থাকেন, তা হলে আপনার নাক এক ইঞ্চি করে ছোট হয়ে যাবে।