শাহনাজ কাঁদো–কাঁদো গলায় বলল তোমার কেমন লাগছে সোমা আপু? ব্যথা। সোমা অনেক কষ্ট করে বলল, বুকের মাঝে ভয়ানক ব্যথা।
শাহনাজ কী করবে বুঝতে না পেরে কাঁদতে শুরু করল। সোমা জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কাদিস না বোকা মেয়ে বেশি ব্যথা হলেই আমি সেন্সলেস হয়ে যাব তখন আর ব্যথা করবে না।
সত্যি সত্যি একটু পর সোমা অচেতন হয়ে পড়ল। চা–বাগানের অফিস থেকে ডাক্তারকে নিয়ে সোমার আব্বা ছুটে এলেন। সোমাকে নানাভাবে পরীক্ষা করা হল এবং ঠিক করা হল তাকে এক্ষুনি শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।
কিছুক্ষণের মাঝে একটা জিপ এনে হাজির করা হল, সেখানে সোমাকে নিয়ে তার আব্বা–আম্মা আর চা–বাগানের ডাক্তার রওনা দিয়ে দিলেন। জিপ স্টার্ট করার আগে সোমা চোখ খুলে শাহনাজকে ফিসফিস করে বলল, একটা অভিজ্ঞতা হবে, কী বলিস? কখনো আমি হাসপাতালে যাই নি!
সোমাকে নিয়ে চলে যাবার পর শাহনাজ আবিষ্কার করল পুরো বাসাটা একেবারে একটা মৃতপুরীর মতো নীরব হয়ে গেছে। বাসায় দেখাশোনা করার জন্য অনেক লোকজন রয়েছে, এখানে থাকতে কোনো অসুবিধে হবে না, কিন্তু হঠাৎ করে শাহনাজের বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। কত আশা করে সে এখানে বেড়াতে এসেছে, সোমার সাথে তার কতকিছু করার পরিকল্পনা, কিন্তু এখন সবই একটা বিশাল দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে।
এর মাঝে ইমতিয়াজ পুরো ব্যাপারটা আরো খারাপ করে ফেলল। সোমাকে হাসপাতালে নেবার পর ইমতিয়াজ একটা বড় হাই তুলে বাসার কাজের মানুষটিকে বলল, আমার জন্য ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে আনন। চা–বাগানে বেড়াতে এসেছি, আমাদের ভালো চা খাওয়াবে না? কী রকম আজেবাজে চা বানাচ্ছ?
কাজের মানুষটি অপ্রস্তুত হয়ে ইমতিয়াজের জন্য নতুন করে চা তৈরি করতে যাচ্ছিল তখন ইমতিয়াজ তাকে থামাল, বলল, ভালো চা তৈরি করতে দরকার ভালো পানি। এখানে স্প্রিং ওয়াটার নাই?
কাজের মানুষটি ইমতিয়াজের কথা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ইমতিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল, স্প্রিং ওয়াটার মানে বোঝ না? পাহাড়ি ঝরনার পানি। নাই?
কাজের মানুষটা ভয়ে ভয়ে বলল, কাছে নাই। দুই মাইল দূরে একটা ঝরনা আছে।
গুড। আজ বিকালে সেখানে যাবে, বালতি করে ঝরনার পানি আনবে। সেই পানিতে চা হবে।
মানুষটি মাথা নেড়ে শুকনো মুখে চলে গেল। শাহনাজ একেবারে হতভম্ব হয়ে ইমতিয়াজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, একজন মানুষ কেমন করে এ রকম হৃদয়হীন হয়? এইমাত্র সোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার কী হবে কে জানে, আর ইমতিয়াজ কীভাবে ঝরনার পানি দিয়ে তার জন্য চা তৈরি করা হবে সেটা নিয়ে হম্বিতম্বি করছে! শাহনাজের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠল, কোনোমতে চোখের পানি সামলানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, ভাইয়া, তোমার ভিতরে কোনো মায়াদয়া নাই?
ইমতিয়াজ কেনো আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, কেন? কী হয়েছে?
সোমাকে এইমাত্র হাসপাতালে নিয়েছে আর তুমি ঝরনার পানিতে চা খাওয়া নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ?
ইমতিয়াজ যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি সেরকম একটা মুখের ভাব করে বলল, সোমাকে হাসপাতালে নিলে আমি চা খেতে পারব না?
শাহনাজ কোনো কথা বলল না। কিছুতেই ইমতিয়াজের সামনে কাঁদবে না ঠিক করে রাখায় সে কষ্ট করে চোখের পানি আটকে রাখল। ইমতিয়াজ মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুব মজা পেয়ে গেল, মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, এখন তুই ফিচ ফিচ করে কাঁদতে শুরু করবি নাকি?
শাহনাজ কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ গভীর জ্ঞানের কথা বলছে এ রকম একটা ভাব করে বলল, আমি সবসময়েই বিশ্বাস করতে চাই যে মেয়ে এবং ছেলের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই। একটা ছেলে যেটা করতে পারে, একটা মেয়েও নিশ্চয়ই সেটা করতে পারে। কিন্তু তোদের দেখে এখন আমার মত পাল্টাতে হবে। ছোট একটা বিষয় নিয়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদবি।
শাহনাজ আর পারল না, চিৎকার করে রাগে ফেটে পড়ল, এইটা ছোট বিষয়? সোমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, এইটা ছোট বিষয়?
ইমতিয়াজ ঠোঁট উন্টে বলল, পরিষ্কার সাইকোসোমেটিক কেন্স। নিউজ উইকে এর ওপরে আমি একটা আর্টিক্যাল পড়েছি, হুবহু এই কেস। দুই গ্রুপ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা হল। এক গ্রুপকে দিল ড্রাগস, অন্য গ্রুপকে প্লাসিবু
শাহনাজ চিৎকার করে বলল, চুপ করবে তুমি? তোমার বড় বড় কথা বন্ধ করবে?
ছোটবোনের মুখে এ রকম কথা শুনে ইমতিয়াজ এবারে খেপে গেল। চোখ ছোট ছোট করে হিন্দি সিনেমার ভিলেনের মতো মুখ করে বলল, আমার সাথে ঘিড়িংগবাজি? একেবারে কানে ধরে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাব।
পারলে নিয়ে যাও না!
ভাবছিস পারব না? আমাকে চিনিস না তুই?
তোমাকে চিনি দেখেই বলছি। শাহনাজ হিংস্র মুখ করে বলল, তোমার হচ্ছে শুধু কথা। বড় বড় কথা। বড় বড় কথা যদি বাজারে বিক্রি করা যেত তা হলে এতদিনে তুমি আরেকটা বিল গেটস হয়ে যেতে।
ইমতিয়াজ শাহনাজের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে কিছু একটা করে ফেলত কিন্তু ঠিক তখন বাসার কাজের মানুষটি চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল বলে সে কিছু করল না। তার হাত থেকে কাপটা নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে মুখে পরিতৃপ্তির একটা ভাব নিয়ে আসে। শাহনাজের পক্ষে ইমতিয়াজের এইসব ভান আর সহ্য করা সম্ভব হল না, সে পা দাপিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।