সোমা তার বিছানায় বসে একটু অবাক হয়ে তার গলায় হাত বুলাচ্ছে। পাশেই সোমার আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন, অবাক হয়ে সোমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হয়েছে, সোমা?
গলার কাছে কী যেন কুট করে উঠল। মশার কামড়ের মতো।
আমি মশার ওষুধ দিতে বলছি, তুই উঠে বসেছিস কেন? শুয়ে থাক।
সোমা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে তার আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মা আমার আর শুয়ে থাকতে হবে না। আমি ভালো হয়ে গেছি। একেবারে ভালো হয়ে গেছি।
আম্মা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, কী বলছিস তুই পাগলের মতো! ডাক্তার বলেছে হার্টে ইনফেকশন
ডাক্তারকে বলতে দাও মা। আমি জানি আমি ভালো হয়ে গেছি। আমার বুকে কোনো ব্যথা নেই, আমার মাথা ঘুরছে না, আমার দুর্বল লাগছে না, আমার এত খিদে পেয়েছে যে আমার মনে হচ্ছে আমি আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব!
কী বলছিস মা তুই!
হ্যা মা। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না, তাই না?
কেমন করে করি? ডাক্তার আজ সকালে এত মনখারাপ করিয়ে দিয়েছে।
ডাক্তার বলেছে আমার হার্ট রক্ত পাম্প করতে পারছে না, তাই আমি খুব দুর্বল। তাই?
হ্যাঁ।
আমি তোমার কাছে প্রমাণ করব। আমি দুর্বল না। আমি কী করব জান?
কী করবি?
আমি তোমাকে কোলে নিয়ে নাচব। বলে সত্যি সত্যি সোমা তার আম্মাকে জড়িয়ে ধরে টেনে উপরে তুলে একপাক ঘুরে এল! তারপর আনন্দে চিৎকার করে বলল, আমি ভালো হয়ে গেছি। আমি ভালো হয়ে গেছি!
সোমার আম্মা খুশিতে কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না, সোমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, খোদা নিশ্চয়ই তোকে ভালো করে দিয়েছে। কিন্তু মা, যতক্ষণ পর্যন্ত ডাক্তার তোকে পরীক্ষা না করছে আমি শান্তি পাব না। তুই চুপ করে শুয়ে থাক। বিকেলবেলা ডাক্তার আসবে।
সোমা মাথা নেড়ে বলল, না আম্মা। আমি শুয়ে থাকতে পারব না। তুমি শুয়ে থাক, আমি হাসপাতালটা ঘুরে দেখি।
কী বলছিস তুই!
আমি ঠিকই বলছি। তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে। তুমি শুয়ে থাক। সোমা সত্যি সত্যি তার আম্মাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
সোমা তার কেবিন থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে ডক্টর জিজি ভাসমান যানটি তার পিছু পিছু বের করে নিয়ে এল। এতবড় একটি ভাসমান যান কীভাবে ছোট দরজা দিয়ে বের হয়ে আসে সেটা নিয়ে শাহনাজ আর অবাক হয় না, কিছুক্ষণ আগে তারা সোমার শরীরের ভিতর থেকে ঘুরে এসেছে। সোমা হেঁটে হেঁটে সাধারণ ওয়ার্ডে এসে উঁকি দিল, সেখানে নানারকম রোগী বিছানায় শুয়ে আছে। সোমা তাদের মাঝে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা বেডের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। চার–পাঁচ বছরের একটা ছোট বাচ্চা বিছানায় শুয়ে আছে, তার কাছে একজন মহিলা, মহিলাটির মাথার চুল এলোমেলো, উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা। সোমা কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল, আপনার কী হয়েছে মা?
মহিলাটি মাথায় হাত দিয়ে ম্লানমুখে হেসে বললেন, কিছু হয় নি মা। আমার বাচ্চাটির সেলুলাইটিস হয়েছিল।
এখন কেমন আছে?
ডাক্তার বলেছে বিপদ কেটে গেছে। আল্লাহ মেহেরবান।
মা, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কয়েকদিন কিছু খান নি, ঘুমান নি, বিশ্রাম নেন নি।
ঠিকই বলেছ মা। মা ম্লানমুখে হাসলেন, ছেলেটাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
সোমা বলল, এখন তো আর দুশ্চিন্তা নেই। এখন আপনি বিশ্রাম নেন। ছেলেটা আমাকে ছাড়ছে না। হাসপাতালের পরিবেশে অভ্যস্ত নয় তো।
আমি আপনার ছেলের সাথে বসি, আপনি ঘুরে আসেন। বাইরে একটা সোফা আছে, বসে দুই মিনিট ঘুমিয়ে নেন।
আমার ছেলে মানবে না, মা।
মানবে। সোমা বিছানার দিকে এগিয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জান আমি ম্যাজিক দেখাতে পারি?
বাচ্চাটি চোখ বড় বড় করে কৌতূহলী চোখে তাকাল। সোমা বিছানার পাশে বসে তার ডান হাত খুলে সেখানে একটা লজেন্স রেখে বলল, আমার এই হাতে একটা লজেন্স। এই দেখ আমি হাত বন্ধ করলাম। সোমা হাত বন্ধ করে তার হাতের উপর দিয়ে অন্য হাত নেড়ে বলল, ছুঃ মন্তর ছু! আকালী মাকালী যাদুমন্তর ছোঃ! তারপর ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন বল দেখি লজেন্সটা কোথায়?
ছেলেটা বড় বড় চোখে সোমার দিকে তাকিয়ে রইল, সোমা আরো বড় বড় চোখ করে বলল, লজেন্সটা চলে গেছে তোমার পকেটে!
ছেলেটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সোমার দিকে তাকিয়ে নিজের পকেটে হাত দিতে গেল, সোমা তার আগেই ছেলেটার হাত ধরে বলল, উহঁ, আগেই পকেটে হাত দেবে না। আমি তো আসল ম্যাজিকটা এখনো দেখাই নি!
ছেলেটা কৌতূহলী চোখে সোমার দিকে তাকাল, সোমা চোখ বড় বড় করে তার ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ রেখে বাম হাত নাড়তে শুরু করে, ছুঃ মন্তর ছুঃ কালী মন্তর ছু! পকেটের লজেন্সটা আবার আমার হাতে চলে আয়!
সোমা এবারে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে তার ডান হাত খুলে বলল, এই দেখ লজেন্সটা তোমার পকেট থেকে আবার আমার হাতে চলে এসেছে।
ছেলেটাকে এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত দেখায় তারপর হঠাৎ করে কৌশলটা বুঝতে পারে, সাথে সাথে বিছানায় উঠে বসে বলল, ঈশ! কী দুষ্ট! আসলে–আসলে লজেন্সটা হাতেই আছে,–আমার পকেটে যায়ই নাই। আমি যেন বুঝতে পারি না–_
সোমা চোখেমুখে ধরা পড়ে যাবার একটা ভঙ্গি করে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রইল, তার পর হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে থাকল। সোমার হাসি দেখে বাচ্চাটাও হাসতে থাকে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাও হাসতে শুরু করেন। হঠাৎ করে পুরো পরিবেশটা আনন্দময় হয়ে ওঠে।