ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছে এটা খুব মজার বুকাংটুকাস ব্যাপার মনে হলেও শাহনাজের ভয়–ভয় করতে থাকে। কোনো কারণে তারা যদি আর বড় না হতে পারে তা হলে কী হবে? কেউ তো কখনো তাদের খুঁজেও পাবে না।
ডক্টর জিজি বলল, আমরা এখন সোমার শরীরে অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছি। সবাই প্রস্তুত থাক।
ভাসমান যানটা হঠাৎ মাথা নিচু করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে, শাহনাজ নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে। ভাসমান যানটা দিক পরিবর্তন করে সামনের পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে পাহাড়ের ঘুঁটিনাটি তাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এটা নিঃসন্দেহে সোমার শরীরের কোনো অংশ, সেটি এখন এত বিশাল যে কোন অংশ আর বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো হাত, কিংবা হাতের আঙুল, কিংবা নাক বা কপাল! ডক্টর জিজি ভাসমান যানটিকে নিয়ন্ত্রণ করে সামনের দিকে ছুটিয়ে নিতে থাকে। সোমার মনে হতে থাকে তারা। বুঝি এক্ষুনি কোনো এক বিশাল পাহাড়ে আঘাত খেয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে সে চোখ বন্ধ করল। সাথে সাথে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা অনুভব করল, সাথে সাথে। চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন ডাবলু আনন্দে চিৎকার করে বলল, নিন্টিফিটাস! শরীরের ভিতরে ঢুকে গেছি!
শাহনাজ ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে বলল, এত অন্ধকার কেন?
শরীরের ভিতরে তো অন্ধকার হবেই। ক্যাপ্টেন ডাবলু ডক্টর জিজিকে বলল, একটু আলো জ্বেলে দাও না।
সাথে সাথে বাইরে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল, শাহনাজ অবাক হয়ে দেখল বিশাল একটা পাইপের মাঝে দিয়ে তারা ছুটে যাচ্ছে পাইপে হলুদ রঙের তরল, তার মাঝে নানা ধরনের জিনিস ভাসছে। ভাসমান যানটিকে হঠাৎ কে যেন প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দেয়, আর সেই ধাক্কায় তারা সামনে ছিটকে পড়ল। শাহনাজ কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কী হয়েছে?
আমরা একটা আর্টারিতে ঢুকেছি। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের সাথে সাথে রক্তের চাপের জন্য এ রকম একটা ধাক্কা খেয়েছি।
রক্ত? শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, বাইরে এটা রক্ত?
হ্যাঁ।
কিন্তু রক্ত তো লাল হবার কথা, হলুদ কেন?
ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, বুঝতে পারছ না শাহপু, আমরা এত ছোট হয়ে গেছি যে সবকিছু আলাদা আলাদা দেখতে পাচ্ছি। হলুদ তরলটা হচ্ছে প্লাজমা। মাঝে মাঝে যে লাল রঙের জিনিস দেখতে পাচ্ছ বড় বড় থালার মতো গোল গোল, সেগুলো হচ্ছে লোহিত কণিকা। আর ঐ সাদা সাদাগুলো, ভিতরে নিউক্লিয়াস, সেগুলো নিশ্চয়ই শ্বেতকণিকা। তাই না ডক্টর জিজি?
ডক্টর জিজি ভাসমান যানটিকে রক্তের স্রোতের মাঝে দিয়ে চালিয়ে নিতে নিতে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
শাহনাজ ভয়ে ভয়ে বলল, কিন্তু শ্বেতকণিকা তো সবসময় শরীরের মাঝে রোগজীবাণুকে আক্রমণ করে! আমাদেরকে আক্রমণ করে ফেলবে না তো?
শাহনাজের কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে অনেকগুলো শ্বেতকণিকা তাদের। ভাসমান যানটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, প্রচণ্ড আক্রমণে তাদের ভাসমান যানটি ওলটপালট খেতে থাকে। শাহনাজ ভয়ে–আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। ডক্টর জিজি বলল, সবাই সাবধান, বাড়তি ত্বরণ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ করে তারা একটা প্রচণ্ড গতিবেগ অনুভব করল, মনে হল কোনো কঠিন জিনিস ভেদ করে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ ওলটপালট খেয়ে একসময় তারা স্থির হল। শাহনাজের সমস্ত শরীর গুলিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এখনি বুঝি হড় হড় করে বমি করে দেবে। ফ্যাকাসে মুখে সে ডক্টর জিজির মুখের দিকে তাকাল, কী হচ্ছে এখানে?
পুরো ভাসমান যানের শরীরে বৈদ্যুতিক চার্জ দিয়ে দিয়েছি। শ্বেতকণিকা এখন আর আক্রমণ করবে না।
শাহনাজ তাকিয়ে দেখল সত্যিই তাই, ভয়ঙ্কর শ্বেতকণিকাগুলো এখন দূরে দূরে রয়েছে, কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। শাহনাজ কী একটা বলতে চাইছিল তার আগেই আবার পুরো ভাসমান যানটি দুলে উঠে প্রচণ্ড ধাক্কায় সামনে এগিয়ে যায়। প্রস্তুত ছিল না বলে ক্যাপ্টেন ডাবলু তার সিট থেকে উল্টে পড়ল, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে উঠে বসে বলল, কী–মজা–হবে আপুর হার্ট কী শক্ত দেখেছ? একেকবার যখন বিট করে, আমরা একেবারে ভেসে যাই।
শাহনাজ অনেক কষ্ট করে বমি আটকে রেখে বলল মানুষের হার্টবিট তো সেকেন্ডে একটা করে হয়। সোমা আপুর এত দেরি করে হচ্ছে কেন?
ডক্টর জিজি বলল, আমাদের নিজেদেরকে সংকুচিত করার জন্য সময় প্রসারিত হয়ে। গেছে। বাইরের সবকিছু এখন খুব ধীরগতি মনে হচ্ছে।
ব্যাপারটি ঠিক কীভাবে হচ্ছে শাহনাজের এখন সেটা বোঝার মতো অবস্থা নেই, সে দুর্বল গলায় বলল, আমরা যদি আর্টারিতে থাকি তা হলে তো হার্ট থেকে দূরে সরে যাব। আর ব্লাডপ্রেশারের এই ধাক্কাগুলো খেতে থাকব। আমাদের এখন কি একটা ধমনীর মাঝে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত না?
ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, এখানে বসে থাকলে নিজ থেকেই ক্যাপিলারি হয়ে চলে যাব। তাই না ডক্টর জিজি?
ডক্টর জিজি মাথা নাড়ল। শাহনাজ ভয়ে ভয়ে বলল, কিন্তু তা হলে তো অনেক সময় লাগবে। তা ছাড়া আর্টারিতে থাকলে তো একটু পরে পরে হার্টের সেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেতে থাকব।
ডক্টর জিজি বলল, আমরা রক্তের স্রোতের ওপর ভরসা না করে নিজেরাই এগিয়ে যাব। তা হলে সময় লাগবে না।
ক্যাপ্টেন ডাবলু আগ্রহ নিয়ে বলল, আমরা শরীরের কোন্ জায়গার ক্যাপিলারিতে যাব?