সোমার আম্মা চমকে উঠে বললেন, কী বললেন আপনি? কী বললেন? আপনি আগেরবার ভুল ইনজেকশন দিয়েছেন?
মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, না, না, না, আমি ভুল ইনজেকশন দিই নাই।
শাহনাজ অবাক হয়ে দেখল মানুষটা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবার কথা বলতে শুরু করেছে, কী মুশকিল! আমি সব কথা দেখি বলে ফেলছি। তুল ইনজেকশন দিয়েছি দেখেই তো এই যন্ত্রণা। ওষুধগুলো চুরি করার জন্য আলাদা করে রেখেছিলাম, তখনই তো গোলমালটা হল।
সোমার আম্মা তীক্ষ্ণচোখে মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ওষুধ চুরি করেন?
মানুষটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, সে কথা না–বলার জন্য নিজের মুখ চেপে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু তবু মুখ থেকে কথা বের হতে থাকে, আমি তো অনেকদিন থেকেই ওষুধ চুরি করছি। শুধু ওষুধ চুরি করলে কী হয়? রোগীদের বিপদের মাঝে ফেলে দিয়ে তাদের থেকে টাকাও আদায় করি। আর গ্রামের সাদাসিধে মানুষ হলে তো কথাই নাই, তাদের এমনভাবে ঠকাই যে বারটা বেজে যায়।
সোমার আম্মা অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, মানুষটা কাঁদো–কাঁদো হয়ে বলল, আমার কী হয়েছে আমি বুঝতে পারছিজ, উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলছি।
উল্টাপাল্টা বলছেন নাকি সত্যিই বলছেন?
মানুষটা আবার প্রাণপণে মুখ বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু তবু তার মুখ থেকে কথা বের হতে থাকে, এ কী বিপদের মাঝে পড়েছি! সব কথা দেখি বলে দিয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে শুরু করেছি। এখন তো মনে হচ্ছে অন্য কথাগুলোও বলে দেব! কয়দিন আগে একজন রোগী এসেছিল, যখন ব্যথায় ছটফট করছে তখন মানিব্যাগটা সরিয়ে দিলাম কেউ টের পেল না! সেদিন ফুড পয়জনিঙে যখন একটা নতুন বউ এল, তার গলার হারটা খুলে নিলাম। ইচ্ছে করে ওভারডোজ ঘুমের ওষুধ দিয়ে রেখেছিলাম। তারপর সেই বাচ্চার কেসটা ধরা যাক–
মানুষটা আর পারল না, দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সোমা ক্ষীণ গলায় বলল, কী হয়েছে আম্মু?
তোকে নাকি একটা ভুল ওষুধ দিয়েছিল তাই ব্যথা কমছে না।
মানুষটা কী ভালো দেখেছ আম্মু? ভুল হয়ে গেছে সেটা নিজেই স্বীকার করল!
ভালো না হাতি! কী কী করেছে শুনিস নি? আস্ত ডাকাত, পুলিশের হাতে দিতে হবে। দাঁড়া আগে ঠিক ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করি।
শাহনাজ অবাক বিস্ময়ে পুরো ব্যাপারটি দেখছিল। এবারে অকারণেই গলা নামিয়ে ডক্টর জিজিকে বলল, তুমি সোমা আপুকে ভালো করে দিতে পারবে?
ডক্টর জিজি কিছুক্ষণ তার যন্ত্রপাতির দিকে তাকিয়ে বলল, মনে হয় পারব।
শাহনাজ হাততালি দিয়ে বলল, সত্যি পারবে?
হ্যাঁ।
কী করতে হবে?
ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতি স্পর্শ করে বলল, সোমার হৃৎপিণ্ডে একটা সমস্যা আছে। তোমরা যেটাকে হৃৎপিণ্ড বল সেখানে একটা ইনফেকশন হয়ে একটা অংশ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা হচ্ছে, এভাবে থাকলে বড় বিপদ হয়ে যাবে।
শাহনাজ ভয় পাওয়া গলায় বলল, সর্বনাশ! কীভাবে এটা ঠিক করবে?
এখান থেকে ঠিক করা যায়। আবার শরীরের ভিতরে ঢুকে হৃৎপিণ্ডে ঢুকেও ঠিক করা যায়।
শরীরের ভিতরে ঢুকে? শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, শরীরের ভিতরে ঢুকবে কেমন করে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু উত্তেজিত গলায় বলল, শাহপু–মনে নাই তোমাকে বলেছিলাম ডক্টর জিজি স্পেসকে ছোট করে ফেলতে পারে? আমরা সবাই মিলে এখন ছোট হয়ে কী–মজা হবে আপুর শরীরে ঢুকে যাব, তাই না ডক্টর জিজি?
ক্যাপ্টেন ডাবলু অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণে শাহনাজের নামটি আরো সংক্ষিপ্ত করে সেটাকে শাহপু করে ফেলেছে, কিন্তু সেটা এখন কেউই খেয়াল করল না। ছোট হয়ে সোমার শরীরের ভিতর ঢুকে যাওয়ার কথাটি সত্যি কি না জানার জন্য শাহনাজ ডক্টর জিজির দিকে তাকাল। ডক্টর জিজি মাথা নাড়ল, বলল, আসলে ব্যাপারটা আমরা যেভাবেই করি না কেন, এর মাঝে টপোলজিক্যাল কিছু স্থানান্তর হবে। কিন্তু তোমাদের মনে হবে তোমরা অনেক ছোট হয়ে সোমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছ।
শাহনাজ বুকের ভিতর আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিল। তারা নিশ্চয়ই এর মাঝে খানিকটা ছোট হয়ে গেছে তা না হলে মাইক্রোবাসের মতো বড় একটা স্পেসশিপ এই ছোট ঘরটায় ঢুকে গেল কেমন করে?
ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতিতে হাত দিতে দিতে বলল, তোমরা শক্ত করে সিট ধরে রাখ, অনেক বড় ত্বরণ হবে।
শাহনাজ শুকনো গলায় বলল, বেশি ঝাঁকুনি হবে না তো? বেশি ঝাঁকুনি হলে আমার আবার শরীর খারাপ হয়ে যায়, বমিটমি করে দিই।
ডক্টর জিজি বলল, কিছু ঝাঁকুনি হতে পারে।
সর্বনাশ! আর সোমা আপু? তার শরীরের ভিতরে ঢুকে যাব–সে ব্যথা পাবে না তো?
চামড়া ফুটো করে শরীরের ভিতরে ঢুকে যাবার সময় একটু ব্যথা পাবে, মশার কামড় বা ইনজেকশনের মতো। তারপর আর টের পাবে না।
ভাসমান যানটি ভোঁতা শব্দ করে ঘরের ভিতরে ঘুরতে শুরু করে। শাহনাজের কেমন জানি ভয়–ভয় করতে থাকে, সে শক্ত করে তার সিটটা ধরে রাখল। ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে দেখল তার মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করছে, উত্তেজনায় সবগুলো দাঁত বের হয়ে আছে। শাহনাজের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, কী খেপচুরিয়াস ফ্যান্টাগ্নিমাস কুকাডুমাস ব্যাপার! কী বুকাংটুকাস, কী নিন্টিফিটাস!
ক্যাপ্টেন ডাবলুর অর্থহীন চিৎকার শুনতে শুনতে শাহনাজ দেখতে পেল সোমার সারা ঘরটা আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করেছে। শুধু ঘরটা নয়, সোমাও বড় হতে শুরু করেছে, মনে হচ্ছে সোমা বিশাল একটা ভাস্কর্যের মতো বড় হয়ে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই মনে হল তারা বুঝি এক বিশাল আদি অন্তহীন প্রান্তরে, বহুদূরে বিশাল পাহাড়ের মতো সোমা শুয়ে আছে, তাকে আর এখন মানুষ বলে চেনা যায় না। ক্যাপ্টেন ডাবলু চিৎকার করে বলল, শাহপু, দেখেছ– মনে হচ্ছে আমরা ঠিক আছি আর সবকিছু বড় হয়ে গেছে? আসলে আমরা ছোট হয়ে গেছি। কী বুকাংটুকাস ব্যাপার!