কাউকে দেখতে হলে তাকে একই সময় এবং একই স্থানে থাকতে হয়। আমরা সময়ের ক্ষেত্রে একটু এগিয়ে আছি, কাজেই আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি কিন্তু তারা আমাদের দেখতে পাচ্ছে না।
সময়ে তারা যখন এগিয়ে আসবে?
তখন আমরাও এগিয়ে যাব, তাই কেউ দেখতে পারবে না।
ক্যাপ্টেন ডাবল ব্যাপারটি এত সহজে মেনে নিতে রাজি হল না। ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক করার প্রস্তুতি নিল, বলল, কিন্তু আমি পড়েছি কিছু দেখতে হলে লাইট কোণের মাঝে থাকতে হয়, কাজেই আমরা যদি তাদের দেখতে পাই তা হলে তারাও আমাদের দেখতে পাবে।
ডক্টর জিজি বলল, ব্যাপারটি বোঝার মতো যথেষ্ট নিউরন তোমাদের নেই। সহজ করে এভাবে বলি–আমাদের কাছে আলো আসছে বলে আমরা তাদের দেখছি, আমাদের এখান থেকে কোনো আলো তাদের কাছে যাচ্ছে না বলে তারা আমাদের দেখছে না।
ক্যাপ্টেন ডাবলু তর্ক করার জন্য আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তাদের ভাসমান যানটি হঠাৎ পুরোপুরি কাত হয়ে একটা বড় বিল্ডিঙের ভিতর ঢুকে গেল, বারান্দা দিয়ে ছুটে গিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। ডক্টর জিজি বলল, সোমা এই ঘরে আছে।
শাহনাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কীভাবে জান?
তোমার মস্তিষ্কে যে তথ্য আছে সেটা ব্যবহার করে বের করেছি।
শাহনাজ কী একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তার আগেই ভাসমান যানটি কাত হয়ে ঘরের মাঝে ঢুকে গেল। শাহনাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল একটা ছোট জায়গার ভিতরে কেমন করে একটা বড় জিনিস ঢুকে পড়ে, কিন্তু তার আগেই তার নজরে পড়ল বিছানায় শুয়ে সোমা ছটফট করছে। তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঠোঁট কালচে এবং মুখ রক্তশূন্য। সোমার কাছে তার আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন, তার মুখ ভয়ার্ত। সোমার হাত ধরে কাতর গলায় বলছেন, কী হয়েছে সোমা? মা, কী হয়েছে?
ব্যথা করছে মা। বুকের মাঝে ব্যথা করছে।
সোমার আম্মা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর চিৎকার লাগলেন, নার্স নার্স। নার্স কোথায়?
আম্মার কথা শুনে কেউ এল না, তখন আম্মা চিৎকার করতে করতে বের হয়ে গেলেন। শাহনাজ বলল, চল আমরা নামি।
ডক্টর জিজি বলল, না। এই গাড়ি থেকে বের হলে তোমাকে দেখতে পাবে। এখন বের হওয়া যাবে না।
শাহনাজ প্রায় কান্না–কান্না হয়ে বলল, কিন্তু সোমা আপার বুকের মাঝে কষ্ট!
ডক্টর জিজি বলল, আমরা সেটা এক্ষুনি দেখব।
ডক্টর জিজির কথা শেষ হবার আগেই সোমার আম্মা আবার ঘরে এসে ঢুকলেন, তার পিছু পিছু একজন পুরুষমানুষ এসে ঢুকল। মানুষটা খুব বিরক্তমুখে সোমার আম্মাকে ধমক দিয়ে বলল, কী হয়েছে? এত চিৎকার করছেন কেন?
আমার মেয়েটার বুকে খুব ব্যথা করছে!
ব্যথা তো করবেই। অসুখ হলে ব্যথা করবে না?
কিন্তু ওষুধ দিয়ে তো ব্যথা কমার কথা, কমছে না কেন?
মানুষটা ধমক দিয়ে বলল, আমি কি ওষুধ তৈরি করি? আমি কেমন করে বলব?
ডক্টর জিজি বলল, বিচিত্র, অত্যন্ত বিচিত্র।
শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, কী বিচিত্র?
এই মানুষটি মুখে একটি কথা বলছে কিন্তু মস্তিষ্কে সম্পূর্ণ অন্য কথা।
মস্তিষ্কে কী কথা বলছে?
মস্তিষ্কে বলছে যে—ভাগ্যিস বেটি জানে না আমি ভুল ওষুধ দিয়ে ফেলেছি!
সর্বনাশ! তাই বলছে ওই বদমাইশ লোকটা? ওই পাজি লোকটা? শয়তান লোকটা?
হ্যাঁ।
এখন কী হবে ডক্টর জিজি? শাহনাজ প্রায় কেঁদে ফেলল, এখন সোমা আপুর কী হবে?
বিশেষ কিছু হবে না। ডক্টর জিজি বলল, সোমার শরীর সামলে নিয়েছে। ভুল ওষুধে বেশি ক্ষতি হয় নি। কিন্তু খুব বিচিত্র।
কী বিচিত্র?
ওই মানুষটার মস্তিষ্ক আবার একটা জিনিস বলছে, কিন্তু মুখে অন্য জিনিস বলছে।
কী বলছে মস্তিষ্কে? কী চিন্তা করছে? তুমি সব শুনতে পাচ্ছ?
ডক্টর জিজি শাহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি একটা কাজ করি তা হলে তোমরাও শুনতে পারবে।
কী করবে?
মানুষটার ভোকাল কর্ডের সাথে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণটা জুড়ে দিই। তা হলে সে যা চিন্তা করবে সেটা জোরে জোরে বলবে।
তুমি করতে পারবে?
পারব।
তোমাকে কি লোকটার ভিতরে যেতে হবে? নাকি এখানে বসেই করবে?
আমি বলে এখানে কিছু নেই। আমি একটা রূপ, আমাদের প্রকৃত অস্তিত্ব এক ও অভিন্ন।
বুঝেছি বুঝেছি বুঝেছি। শাহনাজ মাথা চেপে ধরে বলল, এখন বক্তৃতা না দিয়ে তোমার কাজ শুরু কর।
ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতির মাঝে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা স্পর্শ করল এবং হঠাৎ করে সোমার আম্মার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মাথাটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নড়তে থাকে। সোমার আম্মা এক পা পেছনে সরে ভয় পেয়ে বললেন, কী হয়েছে? আপনার কী হয়েছে?
মানুষটার মাথাটা হঠাৎ যেভাবে নড়তে শুরু করেছিল ঠিক সেরকম হঠাৎ করে আবার থেমে গেল। বলল, না কিছু হয় নাই। খালি মনে হল মগজ থেকে কিছু একটা টেনে বের করে নিয়ে গেল!
সোমার আম্মা অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী বললেন আপনি?
আমি কিছু বলি নাই। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যেটা বলতে চাই নাই সেটাও বলে ফেলেছি! শালার মহাযন্ত্রণা দেখি।
সোমার আম্মা কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মানুষটা থতমত খেয়ে বলল, আমি আপনার মেয়েকে ব্যথা কমানোর জন্য একটা ইনজেকশন দিয়ে দিই। এবারে চেষ্টা করব ঠিক ইনজেকশন দিতে আগেরবারের মতো ভুল যেন না হয়!