ট্রেন ছাড়ার পর শাহনাজ তার সিটে হেলান দিয়ে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে তার এ্যাডভেঞ্চারের বইটি পড়তে থাকে। ইমতিয়াজ তার বিশাল জ্ঞানের বইটি নিয়ে খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি করে, পড়ার ভান করে, কিন্তু শাহনাজ বুঝতে পারল সে এক পৃষ্ঠাও আগাতে পারছে না। কেউ যদি তার দিকে তাকিয়ে থাকত তাহলে মনে হয় আরো খানিকক্ষণ এ রকম চেষ্টা করত কিন্তু ট্রেনের যাত্রীরা সবাই নিজেকে নিয়ে নিজেরাই ব্যস্ত, কাজেই ইমতিয়াজ বেশিক্ষণ এই জ্ঞানের বই পড়ার ভান চালিয়ে রাখতে পারল না। বই বন্ধ করে উসখুস করতে লাগল। খানিকক্ষণ পর যখন একজন হকার কিছু ম্যাগাজিন নিয়ে হাজির হল তার কাছ থেকে সে একটা ম্যাগাজিন কিনল, ম্যাগাজিনটার নাম : খুন জখম সন্ত্রাস, প্রথম পৃষ্ঠায় একজন মানুষের মাথা কেটে ফেলে রাখার ছবি, উপরে বড় বড় করে লেখা : আবার নরমাংসভুক সন্ত্রাসী। ইমতিয়াজ গভীর মনোযোগ দিয়ে ম্যাগাজিনটা গোগ্রাসে গিলতে থাকে।
.
শাহনাজ আর ইমতিয়াজ ট্রেন থেকে নামল দুপুরবেলার দিকে। সেখান থেকে বাসে করে তিন ঘণ্টা যেতে হল পাহাড়ি রাস্তা ধরে। সবশেষে স্কুটারে করে কয়েক মাইল। সোমাদের বাসায় যখন পৌঁছাল তখন সন্ধে হয়ে গেছে।
শাহনাজকে দেখে সোমা যেভাবে ছুটে আসবে ভেবেছিল সোমা ঠিক সেভাবে ছুটে এল না, এল একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কাছে এসে অবশ্য জাপটে ধরে খুশিতে চিৎকার করে উঠে বলল, তুই এসেছিস? আমি ভাবলাম তুই বুঝি ভুলেই গেছিস আমাকে।
শাহনাজও সমান জোরে চিৎকার করে বলল, তুমি ভালো আছ সোমা আপু?
হ্যা ভালো আছি বলেই সোমা আপু থেমে গেল, হাসার চেষ্টা করে বলল, আসলে বেশি ভালো নেইরে।
শাহনাজ দুশ্চিন্তিত মুখে বলল, কেন? কী হয়েছে?
জানি না। বুকের ভিতর হঠাৎ অসম্ভব ব্যথা হয়। তখন হাত–পা অবশ হয়ে যায়, মাঝে মাঝে একেবারে সেন্সলেস হয়ে যাই।
শাহনাজের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ভয়–পাওয়া গলায় বলল, ডাক্তার দেখাও নি?
দেখিয়েছি।
ডাক্তার কী বলে?
ঠিক ধরতে পারছে না। কখনো বলে হার্টের সমস্যা, কখনো বলে নার্ভাস সিস্টেম, কখনো বলে নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার। সোমা কিছুক্ষণ ম্লানমুখে বসে থাকে এবং হঠাৎ করে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বুঝলি শাহনাজ, সবসময় আমার জানার কৌতূহল ছিল সেন্সলেস হলে কেমন লাগে! এখন জেনে গেছি!
শাহনাজ অবাক হয়ে সোমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সোমার আম্মা বললেন, শাহনাজ মা, ভিতরে আস। ভালোই হয়েছে তুমি এসেছ, সোমার একজন সঙ্গী হল। কী যে হল মেয়েটার!
শাহনাজ তার ব্যাগ হাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ভালো হয়ে যাবে চাচি।
দোয়া কোরো না।
ইমতিয়াজ পিছনে পিছনে এসে ঢুকল, মুখে সবজান্তার মতো একটা ভান করে বলল, আমার কী মনে হয় জানেন চাচি?
কী?
সোমার সমস্যাটা হচ্ছে সাইকোসোমেটিক।
সোমার আম্মা ভয়ার্ত মুখে বললেন, সেটা আবার কী?
এক ধরনের মানসিক রোগ।
সোমা চোখ বড় বড় করে বলল, মানসিক রোগ? তার মানে আমি পাগলী? তারপর হি হি করে হেসে বলল, আমি সবসময় জানতে চেয়েছিলাম পাগলীরা কী করে। এখন আমি জানতে পারব।
ইমতিয়াজ আরো কী একটা জ্ঞানের কথা বলতে যাচ্ছিল, শাহনাজ বাধা দিয়ে বলল, সোমা আপু, তুমি ভাইয়ার সব কথা বিশ্বাস কোরো না।
কেন?
কারণ সবকিছু নিয়ে একটা কথা বলে দেওয়া হচ্ছে ভাইয়ার হবি। অমর্ত্য সেনের সাথে দেখা হলেও তাকে একটা কিছু উপদেশ দিয়ে দেবে।
ইমতিয়াজ চোখ পাকিয়ে শাহনাজের দিকে তাকাল, শাহনাজ সেই দৃষ্টি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বলল, ভাইয়ার সাথে যদি কোনোদিন বিল গেটসের দেখা হয় তা হলে সে বিল গেটসকেও কীভাবে কম্পিউটারের ব্যবসা করতে হয় সেটার ওপরে লেকচার দিয়ে দিত।
আরেকটু হলে ইমতিয়াজ খপ করে শাহনাজের চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দিত কিন্তু শাহনাজ সময়মতো সরে গেল। নেহায়েত সোমা, তার আব্বা–আম্মা কাছে ছিলেন তাই ইমতিয়াজ ছেড়ে দিল। তবে কাজটা শাহনাজের জন্য ভালো হল না, ইমতিয়াজ যে তার ওপর একটা শোধ নেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শাহনাজ অবশ্য ব্যাপারটি নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তিত হল না। এখন সে সোমাদের বাসায় আছে, ইমতিয়াজ তাকে কোনোরকম জ্বালাতন করতে পারবে না।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সোমা শাহনাজকে নিয়ে কী কী করবে তার একটা বিশাল লিস্ট তৈরি করল। সেই লিস্টের সব কাজ শেষ করতে হলে অবশ্য শাহনাজকে তার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে, কিন্তু সেটা নিয়ে সোমা কিংবা শাহনাজ কারো খুব মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না।
.
পরদিন ভোরে অবশ্য হঠাৎ করে অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল–সকালবেলা নাশতা করতে করতে হঠাৎ করে সোমার মুখ কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে যায়। শাহনাজ ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, সোমা আপু, কী হয়েছে?
সোমা কোনো কথা বলল না, সে তার বুকে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে। শাহনাজ ভয় পাওয়া গলায় বলল, সোমা আপু!
সোমা কিছু একটা কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু বলতে পারল না, তার সারা মুখে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। শাহনাজ উঠে গিয়ে সোমাকে ধরে চিৎকার করে ডাকল, চাচি!
সোমার আম্মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন, দুজনে মিলে সোমাকে ধরে কাছাকাছি একটা সোফায় শুইয়ে দিল। শাহনাজ সোমার হাত ধরে রাখল। সোমা রক্তহীন মুখে ফিসফিস করে বলল, তোমরা কোনো ভয় পেয়ো না, দেখবে এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে।