কঠিনমুখে বা জোর দিয়ে কিছু বললে ক্যাপ্টেন ডাবলু সেটা সাথে সাথে স্বীকার করে নেয়, এবারেও মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি সেটা স্বীকার করে নিল। শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমরা সেটা কীভাবে বোঝাব?
ক্যাপ্টেন ডাবলু খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, বিজ্ঞানের বড় বড় সূত্র নিয়ে স্লোগান দিই?
বড় বড় সূত্র নিয়ে স্লোগান? শাহনাজ একটু অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকাল।
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, যেমন মনে কর আমি বলব ই ইকুয়েলস টু তুমি বলবে এম সি স্কয়ার! এইটা বলতে বলতে যদি স্পেসশিপে ঘুরে বেড়াই?
একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার বলে স্লোগান দিতে দিতে স্পেসশিপে ঘুরে বেড়াচ্ছে দৃশ্যটি কল্পনা করে শাহনাজ কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। ক্যাপ্টেন ডাবলু কিন্তু নিরুৎসাহিত হল না; বলল, তার সাথে সাথে আমরা যদি পাইয়ের মান প্রথম এক হাজার ঘর পর্যন্ত মুখস্থ বলতে পারি?
শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, পাইয়ের মান এক হাজার ঘর পর্যন্ত তোমার মুখস্থ আছে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু মুখ কাচুমাচু করে বলল, এক হাজার ঘর পর্যন্ত নেই, মাত্র বিশ ঘর পর্যন্ত মুখস্থ আছে। তোমার নেই?
শাহনাজ মাথা নাড়ল, না নেই। পাইয়ের মান এক হাজার ঘর পর্যন্ত মুখস্থ রাখা যে। একটা সাধারণ কর্তব্য মনে করে, তার সাথে কথাবর্তা চালানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। শাহনাজ মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কিংবা আমরা যদি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তার সূত্রটা অভিনয় করে দেখাতে পারি তা হলে কেমন হয়? ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখ বড় বড় করে বলল, আমি হব অবস্থানের অনিশ্চয়তা, তুমি হবে ভরবেগের অনিশ্চয়তা।
না। শাহনাজ মাথা নেড়ে বলল, আমার মনে হয় এসব দিয়ে কাজ হবে না। আমাদেরকে এমন একটা জিনিস খুঁজে বের করতে হবে যেটা পশু থেকে আমাদের আলাদা। করে রেখেছে।
বুদ্ধিজীবী, না হলে সন্ত্রাসী। শুধু মানুষের মাঝে আছে। পশুপাখির নেই।
শাহনাজ একটু বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলল, এখন এইসব ভাবের কথা বলে লাভ নেই, কাজের কথা বল।
শাহনাজের ধমক খেয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলু একটু দমে গেল। মাথা চুলকে বলল, আমি তো আর কিছু ভেবে পাচ্ছি না। ও
শাহনাজ কী একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন শাহনাজের মাথায় চটাৎ করে একটু শব্দ হল, সেখানে কিছু একটা পড়েছে। তারা একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, গাছের ডালে পাখি কিচিরমিচির করছে, কাজেই তার মাথায় কী জিনিস পড়তে পারে সেটা বুঝতে খুব অসুবিধে হবার কথা নয়। কিন্তু এ রকম সময়ে যে তার জীবনে এটা ঘটতে পারে সেটা শাহনাজ বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে মাথা নিচু করে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে দেখিয়ে বলল, দেখ দেখি মাথায় কী পড়ছে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু শাহনাজের মাথার দিকে তাকিয়ে হি হি করে হাসতে শুরু করল, হাসির চোটে তার মুখ থেকে কথাই বের হতে চায় না। অনেক কষ্টে বলল, মাথায় পাখি বাথরুম করে দিয়েছে।
শাহনাজ রেগে বলল, বাথরুম করে দিয়েছে তো তুমি হাসছ কেন?
ক্যাপ্টেন ডাবলু কেন হাসছে সেটা যুক্তিতর্ক দিয়ে ব্যাখ্যা করার কোনো চেষ্টাই করল না, হি হি করে হাসতেই থাকল। শাহনাজ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে রইল। একজন মানুষ অপদস্থ হলে অন্য একজন সেখান থেকে এভাবে আনন্দ পেতে পারে? শুধু তাই নয়, আনন্দটিতে যে কোনো ভেজাল নেই সেটি কি ক্যাপ্টেন ডাবলুর এই হাসি দেখে বোঝা যাচ্ছে না? হাসতে হাসতে মনে হয় সে বুঝি মাটিতে লুটোপুটি খেতে শুরু করবে। পৃথিবীতে। শুধুমাত্র মানুষই মনে হয় এ রকম হৃদয়হীন হতে পারে–এ রকম সম্পূর্ণ অকারণে হাসতে পারে!
ঠিক তক্ষুনি শাহনাজের মাথায় বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা জিনিস খেলে যায়। হাসি! হাসি হচ্ছে একটি ব্যাপার যে ব্যাপারটি মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে রেখেছে। কোনো পশু হাসতে পারে না, শুধু মানুষ হাসতে পারে। হাসি ব্যাপারটির সাথে বুদ্ধিমত্তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ যে অত্যন্ত উন্নত একটি প্রাণী তার প্রমাণ হচ্ছে এই হাসি। মানুষ কেন হাসে সেটি নিয়ে পৃথিবীতে শত শত গবেষণা হয়েছে, সেই গবেষণা এখনো শেষ হয় নি, কিন্তু একটি ব্যাপার নিশ্চিত হয়েছে মানুষের নির্ভেজাল হাসি হচ্ছে বুদ্ধিমান মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কাজেই স্পেসশিপে গিয়ে মহাকাশের প্রাণীদের সামনে গিয়ে তারা যদি এভাবে হাসতে পারে। তা হলে মহাকাশের প্রাণীদের মানুষের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এতটুকু সন্দেহ থাকবে না।
শাহনাজ এবারে সম্পূর্ণ অন্যদৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন ডাবলুর হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু ছিল, কারণ হঠাৎ করে ক্যাপ্টেন ডাবলু তার হাসি থামিয়ে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে শাহনাজপু?
স্পেসশিপের প্রাণীদের কী দেখাতে হবে বুঝতে পেরেছি।
কী?
হাসি।
হাসি? ক্যাপ্টেন ডাবলু ভুরু কুঁচকে তাকাল, কার হাসি? কিসের হাসি?
কার আবার, আমাদের হাসি। মানুষের হাসি হচ্ছে তাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। মানুষ ছাড়া আর কেউ হাসতে পারে না–
তা ঠিক। শিম্পাঞ্জি মাঝে মাঝে হাসির মতো মুখ তৈরি করে, কিন্তু মানুষ যেভাবে হাসে সেভাবে হাসতে পারে না।