শাহনাজের কথা শেষ হওয়ামাত্রই একটি মহাজাগতিক প্রাণী তার একটা হাত তুলে ময়লা ঝেড়ে ফেলার মতো একটা ভঙ্গি করল এবং সাথে সাথে একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে শুরু করে। ঝড়ো হাওয়ার মতো একটা হাওয়া এসে হঠাৎ করে শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলুর উপর দিয়ে বইতে শুরু করে। বাতাসের বেগ দেখতে দেখতে বেড়ে যায়, তারা দুজন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে বাতাস তাদের একেবারে। শূন্যে উড়িয়ে নেয়। দুজন আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। ঝড়ো হাওয়া তাদের কোথাও আছড়ে ফেলবে মনে করে তারা হাত–পা ছড়িয়ে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তারা কোথাও আছড়ে পড়ে না। শূন্যে ভাসতে ভাসতে তারা উপরে–নিচে লুটোপুটি খেতে থাকে এবং কোথায় ভেসে যাচ্ছে তার তাল ঠিক রাখতে পারে না। ধুলোবালি, লতাপাতা, পোকামাকড়সহ তারা ভেসে বেড়াতে এবং কিছু বোঝার আগে তারা নিজেদেরকে মহাকাশযানের বাইরে পাহাড়ের নিচে নিজেদের ব্যাক প্যাকের পাশে আবিষ্কার করল। এত উপর থেকে নিচে পড়ে তাদের শরীরের প্রত্যেকটা হাড় ভেঙে যাবার কথা কিন্তু তাদের কিছুই হয় নি, মনে হচ্ছে কেউ যেন। তাদের ধরে এখানে নামিয়ে দিয়েছে। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তাদের আশপাশ থেকে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল। শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকাল, সে ধুলোয় ডুবে আছে এবং শাহনাজের মনে হল তার বুকপকেটে জীবন্ত কিছু একটা নড়াচড়া করছে। ভালো করে তাকাতেই সে অবাক হয় দেখল ক্যাপ্টেন ডাবলুর পকেট থেকে একটা নেংটি ইঁদুর লাফ দিয়ে বের হয়ে গেল। শাহনাজ আতঙ্কে একটা চিৎকার করে ওঠে। কারো পকেটে একটা জ্যান্ত নেংটি ইঁদুর ঋঞ্চতে পারে সেটি নিজের চোখে না দেখলে সে বিশ্বাস করত না। ক্যাপ্টেন ডাবলু ঘুরে শাহনাজের দিকে তাকাল, কী হয়েছে শাহনাজপু?
তোমার পকেটে একটা ইঁদুর
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, না। আমার পকেটে নাই–তোমার মাথায়।
সত্যি সত্যি শাহনাজের মনে হল তার মাথায় কিছু একটা নড়াচড়া করছে, হাত দিতেই কিছু একটা কিলবিল করে উঠল। শাহনাজ গলা ফটিয়ে চিৎকার করে জিনিসটাকে ছুঁড়ে দেয় এবং আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করে সত্যিই একটা নেংটি ইঁদুর ছুটে পালিয়ে যায়। দুজনে নিজেদের শরীর ঝেড়ে পরিষ্কার করে আরো কিছু পোকামাকড় আবিষ্কার করে। দুজনের প্রায় হার্টফেল করার অবস্থা হল যখন তাদের পায়ের তলা থেকে হলুদ রঙের একটা গিরগিটি এবং দুইটা ব্যাং লাফিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে গেল।
ব্যাপারটা কী হয়েছে? আমরা এখানে এলাম কীভাবে? আর এত পোকামাকড় ব্যাং কোথা থেকে এসেছে? এত ধুলাবালিই কেন এখানে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু নিজের মাথা থেকে ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, আমার কী মনে হয় জান শাহনাজপু? স্পেসশিপের প্রাণীগুলো তাদের স্পেসশিপটা ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করেছে।
ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার?
হ্যাঁ। আমরা হচ্ছি ময়লা আবর্জনা। যত পোকামাকড় ইঁদুর গিরগিটি ব্যাং এর সাথে সাথে আমাদেরকেও ঝাড় দিয়ে বের করে দিয়েছে! যা যা ঢুকেছে সবগুলোকে বের করে দিয়েছে।
ইঁদুর গিরগিটি ব্যাং আর আমরা এক হলাম?
ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার তো তাই মনে হচ্ছে। স্পেসশিপের প্রাণীর কাছে পোকামাকড়ের সাথে নাহয় নেংটি ইঁদুরের সাথে আমাদের কোনো পার্থক্য নাই।
সেটা কেমন করে সম্ভব?
তারা এত উন্নত আর বুদ্ধিমান যে তাদের কাছে মনে হয় সবই সমান। একটা ইঁদুরকে যত বোকা মনে হয় মানুষকেও সেরকম বোকা মনে হয়।
শাহনাজ মুখ শক্ত করে বলল, সেটি হতেই পারে না। মানুষকে কেন বোকা মনে হবে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা চুলকে বলল, আমি কেমন করে বলব?
ওদের কাছে প্রমাণ করতে হবে আমরা অন্য পশুপাখি থেকে অনেক বুদ্ধিমান।
কীভাবে করবে?
ওদেরকে বলতে হবে, বোঝাতে হবে।
তারা যদি তোমার কথা বিশ্বাস না করে শাহনাজপু?
তা হলে প্রমাণ করতে হবে। মানুষ পৃথিবীতে কত কিছু আবিষ্কার করেছে কম্পিউটার থেকে শুরু করে রকেট, পেনিসিলিন থেকে শুরু করে হুপিং কফের টিকা; আর এরা ভাববে আমরা নেংটি ইঁদুরের সমান? এটা কি কখনো হতে পারে?
কিন্তু তাই তো হয়েছে। তারা নিশ্চয় এত উন্নত যে এইসব আবিষ্কার তাদের কাছে মনে হয় একেবারে ছেলেমানুষি! তারা কোনো পাত্তাই দেয় না।
কিন্তু আমরা তো বুদ্ধিমান! আমরা তো পশুপাখি থেকে ভিন্ন।
স্পেসশিপের প্রাণীরা সেটা বুঝতে পারছে না।
শাহনাজ পা দাপিয়ে বলল, আমাদের সেটা বোঝাতে হবে।
পা দাপানোর সাথে সাথে শাহনাজের শরীর থেকে ধুলা উড়ে গিয়ে একটা বিচিত্র দৃশ্যের সৃষ্টি হল। সেই দৃশ্য দেখে এত দুঃখের মাঝেও ক্যাপ্টেন ডাবলু হেসে ফেলল। শাহনাজ রেগে গিয়ে বলল, হাসছ কেন তুমি হ্যাঁ? এর মাঝে হাসির কী হল?
তুমি যখন পা দাপালে তখন ভাইব্রেশানে শরীর থেকে ধুলা বের হয়ে এল! ধুলার সাইজ তো ছোট, মাত্র
এখন সেটা নিয়ে হাসাহাসি করার সময় তোমাকে দেখতে যে একটা উজবুকের মতো লাগছে আমি কি সেটা নিয়ে হেসেছি?
ক্যাপ্টেন ডাবলু হাত দিয়ে শরীরের ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে স্বীকার করল যে তাকে নিয়ে শাহনাজ হাসাহাসি করে নি। শাহনাজ রাগ সামলে নিল, এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজকর্ম করতে হবে। ক্যাপ্টেন ডাবলু বিজ্ঞানের অনেক কিছু জানে কিন্তু বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে কীভাবে কাজ করতে হয় সেটা মনে হয় জানে না; কী করতে হবে সেটা মনে হয় তাকেই ঠিক করতে হবে। শাহনাজ কঠিনমুখে বলল, আমাদের আবার স্পেসশিপটার ভিতরে ঢুকতে হবে। ঢুকে প্রাণীগুলোকে বোঝাতে হবে যে আমরাও উন্নত প্রাণী।