শাহনাজ নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে যে তার কথাই সত্যি বের হয়েছে, মহাজাগতিক প্রাণী সে যেরকম হবে ভেবেছিল প্রাণীগুলো হুবহু সেরকম। ক্যাপ্টেন ডাবলু ফিসফিস করে বলল, কি—কি–ছু একটা বলল।
শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না। মহাজাগতিক প্রাণীকে কি সালাম দেওয়া যায়? তারা কি বাংলা বোঝে? নাকি ইংরেজিতে কথা বলতে হবে? কী করবে বুঝতে না পেরে শাহনাজ আমতা আমতা করে বলল, হ্যাপি মিলেনিয়াম।
প্রাণী দুটি কোনো শব্দ না করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রাণীগুলো একটি চোখের পাতা ফেলল, দুজনে অবাক হয়ে দেখল চোখের পাতাটি উপরে নিচে নয়, ডান থেকে বামে–ঠিক যেরকম শাহনাজ বলেছে। শাহনাজ কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, সে মুখ হাঁ করে প্রাণী দুটির দিকে তাকিয়ে রইল।
০৬. দুটি মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে
দুটি মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে সামনাসামনি দেখা হলে যেরকম ভয় পাওয়ার কথা ছিল শাহনাজ মোটেও সেরকম ভয় পেল না। সে মহাজাগতিক প্রাণীর যেরকম বর্ণনা দিয়েছিল সেটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে, কাজেই প্রাণীগুলোকে ভয় পাওয়ার কোনো। কারণ নেই। কারণ সে জানে প্রাণীগুলো খুব নরম মেজাজের। ভয় না পেলেও শাহনাজ খুব অবাক হয়েছে, কাজেই একটু স্বাভাবিক হতে তার বেশ খানিকক্ষণ সময় লেগে গেল।
ক্যাপ্টেন ডাবলু শুধু অবাক হয় নি, সে ভয়ও পেয়েছে। ঠিক কী কারণে ভয় পেয়েছে সে জানে না, ভয়ের সাথে অবশ্য যুক্তিতর্ক বা কারণের কোনো সম্পর্ক নেই। সে শাহনাজের পিছনে নিজেকে আড়াল করে চোখ বড় বড় করে প্রাণী দুটির দিকে তাকিয়ে রইল। শাহনাজ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, আপনারা আমাদের পৃথিবীতে এসেছেন সেজন্য পৃথিবীর পক্ষ থেকে আপনাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
পৃথিবীতে আগমন–শুভেচ্ছা স্বাগতম বলে একটা স্লোগান দেবে কি না একবার চিন্তা করে দেখল, কিন্তু মহাজাগতিক প্রাণী সেটা ভালোভাবে নাও নিতে পারে। শাহনাজ কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করে বলল, আপনারা এসেছেন খবর পেলে আসলে অনেক বড় বড় মানুষ আপনাদের সাথে দেখা করতে আসত। ফুলটুল নিয়ে আসত। কিন্তু আমরা হঠাৎ করে এসেছি বলে খালি হাতে আসতে হল।
মহাজাগতিক প্রাণী দুটি স্থিরচোখে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে রইল, তার কথা বুঝতে পেরেছে কি না বোঝা গেল না। শাহনাজের হঠাৎ একটু অস্বস্তি লাগতে থাকে। কিন্তু যেহেতু কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে তাই হঠাৎ করে থামার কোনো উপায় নেই; তাকে কথা বলতেই হয়, আপনাদের স্পেসশিপটা আসলে খুবই সুন্দর। যেরকম সাজানো–গোছানো সেরকম পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। আপনাদের কাজকর্ম ভালোভাবে হচ্ছে নিশ্চয়ই। যদি আপনাদের কোনো ব্যাপারে কোনোরকম সাহায্যের দরকার হয় বলবেন। আপনারা কী কী নিতে চাচ্ছেন জানি না, সবকিছু পেয়েছেন কি না সেটাও বলতে পারছি না। এখানে ভালো দোকানপাট নাই, ঢাকার কাছাকাছি নামলে সেখানে অনেক ভালো ভালো দোকান পেতেন।
শাহনাজের কথার উত্তরে কোনো কথা না বলে প্রাণী দুটি তখনো স্থিরচোখে তাকিয়ে রইল। মানুষের একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার সাথে এদের একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার মাঝে একটা পার্থক্য আছে। মানুষের চোখের দিকে তাকালে তার ভিতরে রাগ দুঃখ অভিমান বা অন্য কী অনুভূতি হচ্ছে সেটা অনুমান করা যায় কিন্তু এদের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বোঝার। উপায় নেই। শাহনাজ তবুও হাল ছাড়ল না, আবার কথা বলতে শুরু করল, আপনারা পৃথিবী থেকে অনেক রকম জন্তু–জানোয়ার নিয়ে যাচ্ছেন দেখলাম, নিয়ে কী করবেন ঠিক জানি না। কিছু কিছু জন্তু–জানোয়ার কিন্তু একটু রাগী টাইপের, একটু সাবধান থাকবেন। যেসব জন্তু–জানোয়ার নিচ্ছেন তার মাঝে একটা নিয়ে আমার একটু কথা বলার ছিল, যদি অনুমতি দেন তা হলে বলি।
মহাজাগতিক প্রাণী অনুমতি দিল কি না বোঝা গেল না, কিন্তু শাহনাজ বলতে শুরু করল, যে প্রাণীটা নিয়ে কথা বলছি সেটা আসলে আমার ভাই, ইমতিয়াজ। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। নিজের ভাই কাজেই বলা ঠিক না, কিন্তু না বলেও পারছি না। আমার এই ভাই কিন্তু পুরোপুরি অপদার্থ। আমরা যেটাকে বলি ভুয়া। একেবারে ভুয়া।
আপনারা পৃথিবী থেকে অনেক আশা করে একজন মানুষ নিচ্ছেন সেটা ভালো দেখে নেওয়া উচিত। এ রকম ভুয়া একজন মানুষ নেওয়া কি ঠিক হবে? কাজেই আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনি আমার ভাইকে ছেড়ে দেবেন। আমি আপনাকে লিখে দিতে পারি আমার ভাই ইমতিয়াজকে নিলে আপনাদের লাভ থেকে ক্ষতি হবে অনেক বেশি। মানুষ সম্পর্কে যেসব তথ্য পাবেন তার সবগুলো হবে ভুল। তারা কীভাবে চিন্তা করে, কীভাবে কাজ করে সেই সম্পর্কেও আপনাদের ধারণা হবে ভুল। তাকে বিশ্লেষণ করে আপনাদের ধারণা হতে পারে যে, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পোস্ট মডার্ন কবিতা নামের বিদ্ঘুটে জিনিস লিখে। লিখে পরিচিত–অপরিচিত সব মানুষকে বিরক্ত করা।
শাহনাজ বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, কাজেই, এই পৃথিবীর সম্মানিত অতিথিরা, আপনারা আমার ভাইকে ছেড়ে দেন। আমরা এই ভুয়া মানুষটিকে নিয়ে যাই।
শাহনাজ তার এই দীর্ঘ এবং মোটামুটি আবেগ দিয়ে ঠাসা বক্তৃতা শেষ করে খুব আশা নিয়ে মহাজাগতিক প্রাণী দুটির দিকে তাকাল, কিন্তু প্রাণী দুটি ডান থেকে বামে চোখের পাতা ফেলা ছাড়া আর কিছুই করল না। শাহনাজের সন্দেহ হতে থাকে যে হয়তো তারা তার কথা কিছুই বুঝতে পারে নি। সে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন? বুঝে থাকলে কিছু একটা বলেন, নাহয় কিছু একটা করেন।