ক্যাপ্টেন ডাবলুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শাহনাজ রেগেমেগে বলল, তুমি এতক্ষণ বাইরে বসে কী করছিলে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু অবাক হয়ে বলল, এতক্ষণ? বাইরে বসে? কী বলছ তুমি?
তোমাকে না বলেছিলাম বাইরে গিয়েই সাথে সাথে আবার চলে আসবে?
তাই তো করেছি! একলাফে বাইরে গিয়েছি, আরেক লাফে ভিতরে ঢুকেছি।
হতেই পারে না। আমি এতক্ষণ থেকে বসে বসে সব জন্তু–জানোয়ারকে নিতে দেখলাম। সবশেষে যখন ভাইয়াকে ধরে নিচ্ছে– হঠাৎ করে কী হল কে জানে শাহনাজ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। বড়
ক্যাপ্টেন ডাবলু কিছুই বুঝতে পারল না। সে তাদের কথামতো একলাফে বাইরে গিয়েছে তারপর আরেক লাফে ভিতরে এসে ঢুকেছে। এর মাঝে এতকিছু ঘটে গেছে সেটা সে একবারও কল্পনা করে নি। শাহনাজকে কাঁদতে দেখে সে বিশেষ ঘাবড়ে গেল। কীভাবে তাকে শান্ত করবে বুঝতে না পেরে ছটফট করতে লাগল। ইতস্তত করে বলল, শাহনাজপু তুমি কেঁদো না, প্লিজ তুমি কেঁদো না–
বয়সে ছোট একটা ছেলের সামনে কেঁদে ফেলে শাহনাজ নিজের ওপর নিজেই রেগে উঠেছিল। সে এবারে রাগটা ক্যাপ্টেন ডাবলুর ওপর ঝাড়ল, গলা ঝাজিয়ে চিৎকার করে বলল, তোমার ভাইকে যদি আচার বানিয়ে নিয়ে যেত তা হলে দেখতাম তুমি কাঁদতে কি না–_
আচার?
শাহনাজ চোখ মুছে বলল, সেরকমই তো মনে হল। বড় বড় বোতলের মাঝে যেভাবে আচার বানিয়ে রাখে সেইভাবে সবাইকে ধরে ধরে নিয়ে গেল।
ক্যাপ্টেন ডাবলু চিন্তিতমুখে বলল, শাহনাজপু, এই স্পেসশিপটা যত উন্নত ভেবেছিলাম আসলে তার থেকেও বেশি উন্নত।
কেন?
দেখছ না বাইরে একরকম সময়, ভিতরে অন্যরকম। আমি এক সেকেন্ডের মাঝে বাইরে থেকে এসেছি আর এদিকে কত সময় পার হয়ে গেছে!
শাহনাজ শক্ত মুখে বলল, তাতে লাভ কী হচ্ছে?
তার মানে যারা এই স্পেসশিপটা এনেছে তারা আসলেই খুব উন্নত। তারা অনেক বুদ্ধিমান। তাদেরকে বোঝালেই তারা তোমার ভাইয়াকে ছেড়ে দেবে।
ছাড়বে না। শাহনাজের আবার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। যে ভাই তার জীবনকে একেবারে পুরোপুরি বিষাক্ত করে রেখেছে তাকে বাঁচানোর জন্য চোখে পানি এসে যাচ্ছে ব্যাপারটা এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। কোনোমতে কান্না সামলিয়ে বলল, আমি রোবটগুলোকে কত বোঝালাম, ছেড়ে দিতে বললাম, তারা ছাড়ল না। বরং আমাকে যা একটা আছাড় দিল, এখনো মাথাটা টনটন করছে।
ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, ওগুলো তো রোবট ছিল। রোবটগুলো তো কিছু বোঝে না। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আসল প্রাণীগুলোকে যারা সত্যিকারের বুদ্ধিমান। তাদেরকে বুঝিয়ে বললেই দেখো তারা ছেড়ে দেবে।
তাদেরকে কেমন করে বোঝাব? তারা কি বাংলা জানে? আমাদের কথা কি বুঝবে?
উন্নত প্রাণী সবসময় নীচুশ্রেণীর প্রাণীকে বুঝতে পারে।
ক্যাপ্টেন ডাবলুর কথায় শেষ পর্যন্ত শাহনাজ খানিকটা আশা ফিরে পেল। বলল, চল তা হলে খুঁজে বের করি কোথায় আছে।
চল।
দুজনে তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে মহাকাশযানের ভিতর হাঁটতে শুরু করে। স্পেসশিপের ভিতরে নানারকম গলিঘুপচি, নানারকম বিচিত্র যন্ত্রপাতি। তাদের ফাঁকে ফাঁকে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু হাঁটতে শুরু করে। ভিতরে নানারকম শব্দ। কোথাও কোথাও ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, কোথাও বেশ গরম। স্পেসশিপের ভিতরে কোথাও কোনোরকম আলো জ্বলছে না কিন্তু তবু ভিতরে এক ধরনের নরম স্নিগ্ধ আলো। শাহনাজ হাঁটতে হাঁটতে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে জিজ্ঞেস করল, এই প্রাণীগুলো দেখতে কী রকম হবে মনে হয়? মাকড়সার মতো হবে না তো? তা হলে আমি ঘেন্নায়ই বমি করে দেব।
মনে হয় না। বুদ্ধিমান প্রাণী হলে মনে হয় একটু মানুষের মতো হওয়ার কথা। বাইনোকুলার ভিশনের জন্য কমপক্ষে দুইটা চোখ দরকার, আমার মনে হয় বেশি হবে। চোখগুলো ব্রেনের কাছে থাকা দরকার, শরীরের উপরের অংশে হলে ভালো। কাজ করার জন্য আঙুল না হলে ঔড় দরকার। অক্টোপাসের মতো, যত বেশি হয় তত ভালো।
শাহনাজ ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কেমন করে জান?
একটা বইয়ে পড়েছি। ক্যাপ্টেন ডাবলু একটু অপেক্ষা করে বলল, তোমার কী রকম হবে বলে মনে হয়?
আমার মনে হয় সবুজ রঙের হবে।
সবুজ? সবুজ কেন হবে?
জানি না। চোখগুলো হবে বড় বড়। একটু টানা টানা। চোখের পাতা উপর থেকে নিচে পড়বে না, ডান থেকে বামে পড়বে। নাকের জায়গায় শুধু গর্ত থাকবে। মুখ থাকবে না।
মুখ থাকবে না? মুখ থাকবে না কেন?
আমার মনে হয় মুখ থাকলেই সেখানে দাঁত থাকবে আর দাঁত থাকলেই ভয় করবে। সেই জন্য মুখই থাকবে না।
ক্যাপ্টেন ডাবলু খিকখিক করে হেসে বলল, শাহনাজপু, তোমার কথাবার্তা একেবারে আনসায়েন্টিফিক।
হতে পারে। তুমি জিজ্ঞেস করেছ তাই বলছি।
ক্যাপ্টেন ডাবলু হাসি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, হাত–পা কি থাকবে? লেজ?
না লেজ থাকবে না। দুইটা হাত, দুইটা পা থাকবে। প্রত্যেকটা হাতে তিনটা করে আঙুল। পেটটা একটু মোটা হবে। মাথাটা শরীরের তুলনায় অনেক বড়। যখন হাঁটবে তখন মনে হবে এই বুঝি তাল হারিয়ে পড়ে গেল।
ক্যাপ্টেন ডাবলু আবার হেসে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু সামনে তাকিয়ে হঠাৎ সে পাথরের মতো জমে গেল। তাদের কয়েক হাত সামনে দুটি মহাজাগতিক প্রাণী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রং সবুজ, শরীরের তুলনায় অনেক বড় মাথা, সেখানে বড় বড় দুটি চোখ স্থিরদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নাকের জায়গায় দুটি গর্ত, কোনো মুখ নেই। দুটি ছোট ছোট পা, তুলনামূলকভাবে লম্বা হাত। প্রতি হাতে তিনটা করে আঙুল। ঠিক যেরকম শাহনাজ বর্ণনা করেছিল। ক্যাপ্টেন ডাবলু বিস্ফারিত চোখে মহাজাগতিক প্রাণী দুটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর শাহনাজের দিকে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, শা–শা–শাহনাজপু–তো–তো–তোমার কথাই ঠিক।