ক্যাপ্টেন ডাবলু ভিতরে আসছে না দেখে শেষ পর্যন্ত শাহনাজ ঠিক করল সেও বাইরে যাবে। স্পেসশিপের দরজায় লাফিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সে হঠাৎ স্পেসশিপের ভিতরে ঘরঘর এক ধরনের শব্দ শুনতে পায়। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝার জন্য শাহনাজ এদিক–সেদিক তাকাল। স্পেসশিপের ভিতরে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, নানা ধরনের জটিল জিনিসপত্র–সেগুলো দেখতে সম্পূর্ণ অন্যরকম, হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় বুঝি কোনো অতিকায় পোকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তার ভিতর দূরে একটি জায়গা থেকে ঘরঘর শব্দ করে কিছু একটা আসছে। শাহনাজ কী করবে বুঝতে পারল না, লাফিয়ে বাইরে চলে যাবে। নাকি ভিতরেই কোথাও লুকিয়ে পড়বে ঠিক করতে করতে মূল্যবান খানিকটা সময় চলে গেল। ঘরঘর শব্দ করে যে জিনিসটা আসছে সেটা দেখতে দেখতে কাছে চলে আসছে। শাহনাজ কী করবে বুঝতে না পেরে লাফিয়ে এক কোনায় বিচিত্র আকারের একটা পিলারের পিছনে লুকিয়ে গেল।
ঘরঘর শব্দ করে যে জিনিসটি আসছে সেটা একেবারে কাছে চলে এসেছে। শাহনাজ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল, এবং হঠাৎ করে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। জিনিসটি একটা হাতি–কোনো বিচিত্র উপায়ে সেটাকে মূর্তির মতো স্থির করিয়ে স্বচ্ছ চতুষ্কোণ একটা বাক্সের মাঝে আটকে রাখা হয়েছে, বাক্সের নিচে ছোট ছোট রোলার, সেই রোলার ঘোরার কারণে ঘরঘর শব্দ হচ্ছে। বাক্সটি কীভাবে যাচ্ছে সেটা দেখার জন্য শাহনাজ মাথা বের করে বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে। ছোট একটি রোবট হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে স্বচ্ছ বাক্সটি নিয়ে যাচ্ছে–শাহনাজের চিৎকার শুনেও রোবটটা তার দিকে ঘুরে তাকাল না। হাতির পরে অন্য একটি চতুষ্কোণ বাক্সে একটা মাঝারি মহিষ, তার পিছনে একটা হরিণ, হরিণের পর একটা মাঝারি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিশ্চয়ই এখান থেকে বের হতে পারবে না, তবু শাহনাজের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ছোট ছোট পেটমোটা বেঁটে ধরনের রোবটেরা একটার পর একটা স্বচ্ছ বাক্স ঠেলে ঠেলে নিতে থাকে এবং সেইসব বাক্সের মাঝে গরু, ছাগল, ভেড়া থেকে শুরু করে সাপ, ব্যাঙ, পাখি, গিরগিটি, টিকটিকি, কিছুই বাকি থাকে না। এমন এমন বিচিত্র প্রাণী মাঝে মাঝে নিয়ে যেতে থাকে যেগুলো সে শুধু বইপত্রে ছবি দেখেছে। অক্টোপাস দেখলে যে এ রকম গা ঘিনঘিন করতে পারে সেটা নিজের চোখে দেখলে বিশ্বাস করত না। প্রাণীগুলো নড়ছে না, মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে কিন্তু তবু। দেখে বোঝা যায় সেগুলো জীবন্ত। কোনোভাকে অচেতন করে রেখেছে। স্পেসশিপের বুদ্ধিমান প্রাণীরা নিশ্চয়ই পৃথিবী থেকে ধরনের জন্তু–জানোয়ার একটি করে নিয়ে। যাচ্ছে–কে জানে তাদের জগতের চিড়িয়াখানায় হয়তো সাজিয়ে রাখবে।
শাহনাজের চিৎকার শুনেও বেঁটে পেটমোটা রোবটগুলো তার প্রতি কোনো গুরুত্ব না। দেওয়ায় তার একটু সাহস বেড়ে গেল। সে বিচিত্র পিলারের আড়াল থেকে বের হয়ে পৃথিবীর যাবতীয় জীবজন্তুকে স্বচ্ছ বাক্সে ভরে টেনে টেনে নেওয়ার দৃশ্যটি বাইরে দাঁড়িয়েই দেখতে শুরু করল। একটা ক্যাঙ্গারুকে লাফ দেওয়ার মাঝখানে আটকে ফেলে নিয়ে যাচ্ছিল, শূন্যে ঝুলে থাকা ক্যাঙ্গারুর বাক্সটা নিয়ে যাবার সময় সে বাক্সটা একটু ছুঁয়েও দেখল, পেটমোটা রোবটটা তাকে কিছু বলল না। ক্যাপ্টেন ডাবলু কেন এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বোঝা মুশকিল, ভিতরে এলে সে এই বিচিত্র প্রাণীকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখতে পেত। বাইরে গিয়ে সে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে নিয়ে আসবে কি না সেটা নিয়ে সে যখন নিজের সাথে মনে মনে তর্ক করছে তখন হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে হঠাৎ করে তার সমস্ত শরীর জমে যায়। সে এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে রোবটগুলো পর্যন্ত এবার মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। শাহনাজ দেখতে পেল একটা রোবট স্বচ্ছ একটা বাক্স ঠেলে ঠেলে আনছে এবং ঠিক তার মাঝখানে ক্যামেরায় ছবি তোলার ভঙ্গি করে ইমতিয়াজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে–এক চোখ বন্ধ অন্য চোখ খোলা, বাম হাতে ক্যামেরা ধরে রাখার ভঙ্গি, ডান হাত। দিয়ে শাটারে চাপ দিচ্ছে–শুধুমাত্র হাতে ক্যামেরাটা নেই। মহাজাগতিক প্রাণী পৃথিবীর নানা জীব–জানোয়ার একটি করে নিয়ে যাচ্ছে, এর মাঝে একটি মানুষও আছে। মানুষ হিসেবে যাকে বেছে নিয়েছে সেটি হচ্ছে ইমতিয়াজ! কী সর্বনাশ! শাহনাজের জীবনকে ইমতিয়াজ মোটামুটি বিষাক্ত করে রেখেছে সত্যি, তাই বলে এভাবে ধরে নিয়ে চলে যাবে সেটা তো কখনো শাহনাজ চিন্তাও করে নি।
কী করবে বুঝতে না পেরে সে হঠাৎ চিৎকার করে বেঁটে পেটমোটা রোবটটার দিকে ছুটে গেল। রোবটটাকে ধরে টানাটানি করে চিৎকার করে বলতে লাগল, ছেড়ে দাও! একে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও বলছি–ভালো হবে না কিন্তু
রোবটটা নির্লিপ্তভাবে শাহনাজের দিকে তাকাল, মনে হল শাহনাজের কাজকর্ম দেখে সে খানিকটা অবাক এবং বিরক্ত হয়েছে। শাহনাজ রোবটটার ঘাড় ধরে তাকে থামানোর চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল এবং রোবটটার পিছু পিছু ছুটতে লাগল। শেষ পর্যন্ত রোবটটার মনে হয় খানিকটা ধৈর্যচ্যুতি হল, সেটা একটা হাত তুলে শাহনাজকে ধরে খানিকটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। মাথাটা বেকায়দা কোথায় ঠুকে গিয়ে মনে হল চোখের সামনে কিছু হলুদ ফুল ঘুরতে থাকে। চোখে সর্ষেফুল দেখা কথাটা যে বানানো কথা নয়, সত্যি সত্যি কিছু একটা দেখা যায়, এই প্রথমবার শাহনাজ টের পেয়েছে। সে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে উঠে বসে। এবং দেখতে পেল ক্যাপ্টেন ডাবলু অদৃশ্য পরদায় আটকা পড়ে হাত–পা ছুঁড়ে হচড়পাঁচড় করতে করতে কোনোমতে ভিতরে এসে ঢুকেছে। শাহনাজকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে সে অবাক হয়ে বলল, কী হল শাহনাজপু, তুমি নিচে বসে আছ কেন?