ফাজলেমি করবে না। এটা ফাজলেমির সময় না।
সাথে সাথে ক্যাপ্টেন ডাবলু গম্ভীর মুখে বলল, তা ঠিক।
তা হলে এখন কী করা যায়?
আমার মনে হয় আমাদের স্পেসশিপের ভিতরে ঢোকা উচিত।
সত্যি?
হ্যাঁ। আমি একটা বইয়ে পড়েছি একটা প্রাণী যখন খুব উন্নত হয় তখন তারা কাউকে মেরে ফেলে না। প্রাণী যত উন্নত হয় তার তত বেশি ভালবাসা হয়।
শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলল, কে জানে সেটা সত্যি কি না। ভিন্ন জগতের উন্নত প্রাণীর ভালবাসা কেমন হয় কে জানে! হয়তো ধরে নিয়ে খাঁচায় রেখে দেওয়া হবে তাদের ভালবাসা, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে আলোচনা করার সময় খুব বেশি নেই। ইমতিয়াজকে দেখা যাচ্ছে না–মনে হচ্ছে তাকে নিশ্চয়ই স্পেসশিপের ভিতরেই নিয়ে গেছে, সেটাও তো একবার দেখা দরকার। শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে বলল, চল তা হলে যাই। আমাদের কি সত্যি ভিতরে ঢুকতে দেবে?
দেবে না কেন? নিশ্চয়ই দেবে।
ক্যাপ্টেন ডাবলু আর শাহনাজ তখন গুটিগুটি এগিয়ে যেতে শুরু করে। মহাকাশযানটির কাছে এসে সাবধানে সেটাকে স্পর্শ করতেই তাদের শরীরে এক ধরনের শিহরন খেলে গেল। স্পেসশিপটি বিচিত্র এক ধরনের পদার্থ দিয়ে তৈরি। ভালো করে তাকালে দেখা যায় এক ধরনের নকশা কাটা রয়েছে। চকচকে মসৃণ দেহ, কিন্তু ঠিক ধাতব নয়। দুজনে হাত বুলিয়ে আরো ভিতরের দিকে যেতে শুরু করে। স্পেসশিপটি অস্বাভাবিক শক্ত, বিশাল পাহাড় ভেদ করে বের হয়ে এসেছে কিন্তু কোথাও সেই ভয়ঙ্কর ঘর্ষণের চিহ্ন নেই। দেখে মনে হয় এটা শক্ত পাথর ভেদ করে বের হয় নি, নরম কাদার মতো কিছু একটা ভেদ করে বের হয়েছে। মহাকাশযানের সূক্ষ্ম অংশগুলো পর্যন্ত শক্ত পাথরকে একেবারে মাখনের মতো। কেটে ফেলেছে। মহাকাশযানটি কী দিয়ে তৈরি কে জানে যে এত সহজে এত শক্ত পাথরকে এভাবে কেটে ফেলে?
শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলুর ধারণা ছিল মহাকাশযানের ভিতরে ঢোকা নিয়ে একটা সমস্যা হবে, কোনো ফুটো খুঁজে বের করে সাবধানে তার ভিতর দিয়ে ঢুকতে হবে। কিন্তু দেখা গেল কাছাকাছি একটা বড় দরজা হাট করে খোলা আছে। দুজনে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি দেয়। ঠিক কী কারণ কে জানে, ভিতরে ভালো করে দেখা যায় না। এমন নয় যে ভিতরে অন্ধকার বা অন্যকিছু, বেশ আলোকোজ্জ্বল, কিন্তু তবুও কেন জানি কোনোকিছুই স্পষ্ট নয়। ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, শাহনাজপু চল ভিতরে ঢুকি।
অন্য কোনো সময় হলে শাহনাজ কী করত জানে না, কিন্তু এখন আর অন্যকিছু করার উপায় নেই। সে বলল, চল।
দুজন প্রায় একসাথে ভিতরে পা দেয়–সাথে সাথে দুজনেরই বিচিত্র একটা অনুভূতি হল, মনে হল তারা বুঝি তেলতেলে ভিজে শীতল আঠালো একটা অদৃশ্য পরদার মাঝে আটকে গেছে–ছোট ছোট পোকা মাকড়সার জালে যেভাবে আটকে যায় অনেকটা সেরকম। হাত–পা ছুঁড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে কোনোমতে তারা সেই পরদা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল এবং তখন মনে হল অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি তাদের যেন শুষে ভিতরে টেনে নিল। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু দুজনে প্রায় একসাথে ভিতরে লুটোপুটি খেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে। কোনোমতে দুজন সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং ভিতরে তাকিয়ে একেবারে হতচকিত হয়ে যায়। তাদের মনে হয় তারা বুঝি আদিগন্তহীন বিশাল একটা স্পেসশিপের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে যে জিনিসটি কয়েক শ মিটার ভিতরে সেটা কীভাবে এ রকম বড় হয়, দুজনের কেউই বুঝতে পারল না। ক্যাপ্টেন ডাবলু হাত দিয়ে তার চশমা ঠিক করতে করতে বলল, ও মাই মাই মাই–মাইগো মাই!
কথাটা নিশ্চয় অবাক হবার কথা, কাজেই শাহনাজ সেটার অর্থ নিয়ে মাথা ঘামাল না, নিচু গলায় বলল, কী মনে হয়?
কেস ডিঞ্জুফিটাস।
তার মানে কী?
ক্যাপ্টেন ডাবলু উত্তর না দিয়ে মাথা চুলকাতে থাকে। সে বিজ্ঞানের অনেক কিছু জানে, কিন্তু এখন যেসব জিনিস দেখছে সেগুলো তার জানা বিষয়ের মাঝে পড়ে না। শাহনাজ বলল, আমার কী মনে হয় জান?
কী?
প্রথমেই এখান থেকে কীভাবে বের হব সেই জিনিসটা ঠিক করে নেওয়া দরকার। চোরেরা যখন চুরি করতে আসে তখন প্রথমেই পালানোর ব্যবস্থাটা ঠিক করে নেয়।
ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখ বড় বড় করে বলল, আমরা কি চোর?
শাহনাজ অধৈর্য হয়ে বলল, চোর না হলেও চোরের টেকনিক ব্যবহার করলে কোনো দোষ হয় না।
তা ঠিক। কী করবে এখন?
প্রথমেই এখান থেকে বের হয়ে দেখি দরকার পড়লে বের হতে পারব কি না।
ঠিক আছে।
দুজনেরই বের হওয়ার দরকার নেই, একজন বের হওয়া যাক, আরেকজন ভিতরে থাকি।
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল। শাহনাজ যেহেতু বড়, তাই সে ভিতরে থাকবে বলে ঠিক করল। ক্যাপ্টেন ডাবলু উঠে দাঁড়িয়ে খোলা দরজায় সেই অদৃশ্য তেলতেলে আঠালো ভিজে শীতল পরদার মাঝে লাফিয়ে পড়ল। শাহনাজ দেখতে পেল ক্যাপ্টেন ডাবলু সেই পরদায় আটকা পড়েছে, হাত–পা ছুঁড়ে বের হবার চেষ্টা করছে এবং কিছু বোঝার আগে হঠাৎ পরদা থেকে ছুটে বাইরে চলে গেছে। শাহনাজ সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়। মহাকাশযান থেকে ঢোকা এবং বের হওয়া ব্যাপারটি একটু অস্বস্তিকর হতে পারে, কিন্তু কঠিন নয়। সত্যি কথা বলতে কী, ব্যাপারটা ভালোভাবে প্র্যাকটিস করলে একটা মজার খেলাও হতে পারে! ক্যাপ্টেন ডাবলুকে বলে দেওয়া ছিল সে বাইরে গিয়ে আবার সাথে সাথে ভিতরে ফিরে আসবে, কিন্তু শাহনাজ অবাক হয়ে লক্ষ করল সে সাথে সাথে ভিতরে ফিরে এল না। বাইরে দাঁড়িয়ে অহেতুক সময় নষ্ট করতে লাগল। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে। ভিতরে দাঁড়িয়ে বাইরে স্পষ্ট দেখা গেলেও কোনো একটা বিচিত্র কারণে কোনোকিছুই যেন ঠিক করে বোঝা যায় না। স্পেসশিপের দরজার মাঝে যে অদৃশ্য পরদা রয়েছে সেটা যেন দুটি ভিন্ন জগৎ হিসেবে দুটি অংশ আলাদা করে রেখেছে। শাহনাজ অধৈর্য হয়ে হাত নেড়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে ভিতরে আসতে ইঙ্গিত করল, কিন্তু ক্যাপ্টেন ডাবলু মনে হল সেটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ঠাট্টা–তামাশা করতে লাগল। এ রকম সময়েও যে কেউ ঠাট্টা–তামাশা করতে পারে, শাহনাজ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না।