না। ক্যাপ্টেন ডাবলু তার টেস্ট প্যাক থেকে বাইনোকুলার বের করে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখতে দেখতে বলল, তবে পাহাড়ের মাঝে বড় বড় ফাটল দেখা যাচ্ছে। পাথর পর্যন্ত ফেটে গেছে। কিছু একটা হয়ে গেছে এখানে।
শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছ থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকাল। সত্যি সত্যি পাহাড়ের গায়ে বড় বড় ফাটল। ফাটলগুলো একেবারে নতুন তৈরি হয়েছে। পুরোনো হলে গাছগাছালি জন্মে এতদিনে ঢাকা পড়ে যেত। ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, উপরে গিয়ে দেখতে হবে।
শাহনাজের হঠাৎ কেমন জানি একটু ভয় ভয় করতে থাকে, কী আছে উপরে? পরমূহুর্তে তার ইমতিয়াজের কথা মনে পড়ল, ইমতিয়াজের মতো ভীতু মানুষ যদি একা এখানে আসতে পারে তা হলে মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। সে বলল, চল যাই। তারপর ক্যাপ্টেন ডাবলুর ভয়াবহ টেষ্ট প্যাকটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, এটা কি সাথে নিতে হবে?
না। এটা রেখে যাই, শুধু ভিতর থেকে কিছু জিনিস বের করে নিই।
ক্যাপ্টেন ডাবল যেসব জিনিস বের করল—-দুটি ওয়াকিটকি, নাইলনের দড়ি, সুইস আর্মি চাকু, ম্যাগনিফাইং গ্লাস, বড় টর্চলাইট, ছোট শাবল–সব মিলিয়ে বোঝাটি অবশ্য খুব ছোট হল না। আগে একটা ব্যাগে ছিল বলে টেনে নেওয়া সোজা ছিল, এখন জিনিসগুলো শরীরের এখানে–সেখানে ঝুলিয়ে পকেটে, হাতে করে নিতে হল বলে একদিক দিয়ে বরং একটু ঝামেলাই হল। রওনা দেবার আগে শাহনাজ তার স্যান্ডউইচগুলো বের করল। দেখে ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আনন্দে চিৎকার করে বলল, তুমি খাবার এনেছ! আমি ভেবেছিলাম আজকে না–খেয়ে থাকতে হবে!
তোমার বুদ্ধিমতো খালি যন্ত্রপাতি আনলে না–খেয়েই থাকতে হত।
ক্যাপ্টেন ডাবলু স্যান্ডউইচে বড় একটা কামড় দিয়ে বলল, মানুষের শরীরে যদি কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন না হয়ে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন হত তা হলে কী মজা হত, তাই না?
কী মজা হত?
অল্প একটু খেলেই সারা জীবন আর খেতে হত না। সেখান থেকেই ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার হিসেবে কত শক্তি পাওয়া যেত!
নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশনের ব্যাপারগুলো শাহনাজ একটু জানে, তাই সে বলল, তা হলে তোমার স্যান্ডউইচ খেতে হত না। খেতে হত ইউরেনিয়াম ট্যাবলেট।
সাংঘাতিক একটা রসিকতা করেছে এ রকম একটা ভাব করে ক্যাপ্টেন ডাবলু হঠাৎ হা হা করে হাসতে শুরু করল। বিজ্ঞানের মানুষজন কোটাকে হাসির জিনিস বলে মনে করে সেটা বোঝা মুশকিল।
খাওয়া শেষ করে পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে তারা রওনা দিল। পাথরে পা রেখে তারা উপরে উঠতে থাকে। সমান জায়গায় হাঁটা সহজ, কিন্তু উপরে ওঠা এত সহজ নয়, কিছুক্ষণেই দুজনে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে।
সামনে একটা সমতল জায়গায় বড় বড় কয়েকটা গাছ। গাছগুলোকে পাশ কাটিয়ে তারা আবার উপরে উঠতে শুরু করে। সামনে খানিকটা খাড়া জায়গা, এটাকে ঘিরে তারা ডানদিকে সরে গেল। পাথরে পা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা পাহাড়ের একটা বিশাল ফাটলের সামনে এসে দাঁড়াল। ফাটলটা কোথা থেকে এসেছে দেখার জন্য দুজনে এটার পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। সামনে একটা বড় ঝোঁপ, সেটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে যেতেই ক্যাপ্টেন ডাবলু আর শাহনাজ একসাথে চিৎকার করে উঠল। তারা বিস্ফারিত চোখে দেখতে পেল পাহাড়ের বিশাল ফাটল থেকে একটা মহাকাশযান বের হয়ে আছে। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু দুজনেরই প্রথম প্রতিক্রিয়া হল ছুটে কোথাও লুকিয়ে যাওয়া, কিন্তু দুজনেই একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারা নড়তে পারছিল না, বিশাল মহাকাশযানটি থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া একেবারে অসম্ভব একটি ব্যাপার। দুজনে নিশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এবং শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন ডাব নাকমুখ দিয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করে বলল, ডেঞ্জাস্টিক!
শাহনাজ ফিসফিস করে বলল, কী বললে?
সাংঘাবুলাস। ফাটাফাটিস্টিক। একবারে টেরিফেরিস্টিক!
শাহনাজ বুঝতে পারল এগুলো ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুগ্ধ এবং প্রশংসাসূচক কথাবার্তা, সে কথাবার্তা বলতে বলতে চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে আরো কয়েক পা এগিয়ে গেছে। শাহনাজ ভয়–পাওয়া গলায় বলল, বেশি কাছে যেও না ক্যাপ্টেন ডাবলু।
কিছু হবে না। ক্যাপ্টেন ডাবলু কাঁপা গলায় বলল, যারা এই ছ্যাড়াভাড়াস্টিক টেরিফেরিস্টিক ডেঞ্জাবুলাস স্পেসশিপ বানাতে পারে, তারা ইচ্ছা করলে আমাদের যা–খুশি তাই করতে পারে! ভয় পেয়ে লাভ কী?
ক্যাপ্টেন ডাবলু কয়েক পা এগিয়ে যায় এবং উপায় না দেখে শাহনাজও আরো কয়েক পা এগিয়ে যায়। হঠাৎ তার পায়ে কিছু একটা লাগল। শাহনাজ নিচু হয়ে তাকাতেই দেখতে পেল একটা ক্যামেরা। শাহনাজ সাবধানে ক্যামেরাটা তুলে নেয়। চিনতে কোনো অসুবিধে হয় না এটা তার আব্বার ক্যামেরা, ইমতিয়াজ গতকাল এটা নিয়ে ছবি তুলতে এসেছিল। ছবি তুলে নিশ্চয়ই ফিরে যেতে পারে নি, ফিরে যেতে পারলে ক্যামেরাসহই ফিরে যেত। বিখ্যাত হওয়ার জন্য ইমতিয়াজের এই ক্যামেরা ছবিগুলো দরকার।
০৫. শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলু মুখ হাঁ
শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলু মুখ হাঁ করে মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে রইল। কোনোকিছু দেখতে যে এত সুন্দর হতে পারে সেটি না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। গোলাপফুল কিংবা সিনেমার নায়িকারা যেরকম সুন্দর হয়, এটা সেরকম সুন্দর না; এর সৌন্দর্যটা অন্যরকম। বিশাল একটা জটিল জিনিসকে একেবারে নিখুঁত করে তৈরি করার যে। সৌন্দর্য, এর ভিতরে সেইরকম সৌন্দর্য। পৃথিবীর সব যন্ত্রপাতির ভিতরে এক ধরনের মিল রয়েছে। এই মহাকাশযানটির মাঝে সেই যন্ত্রপাতির কোনো মিল নেই। এটি দেখলে যতটুকু যন্ত্রপাতি বলে মনে হয় তার থেকে বেশি মনে হয় যেন এক ধরনের অত্যন্ত আধুনিক ভাস্কর্য–কিন্তু একনজর দেখলেই বোঝা যায় যে আসলে এটি ভাস্কর্য নয়, এটি একটি মহাকাশযান।