শাহনাজ আবার চেষ্টা করল, কিন্তু আমার ভাই বলেছে সে নিজের চোখে দেখেছে।
অন্য কিছু দেখেছেন মনে হয়। ক্যাপ্টেন ডাবলু তার মেটাল ডিটেক্টরটা কাঁধে নিয়ে বলল, যাই, দেখে আসি।
কী দেখে আসবে?
ঝরনাটা। পানি কোথায় গেছে?
আমিও যাব তোমার সাথে।
চল।
শাহনাজ একটু ইতস্তত করে বলল, তোমার আম্মা–আব্বা আবার কিছু বলবেন না তো?
ঝরনাতে গেলে কিছু বলবেন না, কিন্তু
কিন্তু কী?
না থাক! শুনলে তুমি আবার হাসাহাসি করবে। প্যারাসুটের দড়িটা যে পেঁচিয়ে যাবে সেটা কি আমি জানতাম?
ঝরনার সাথে প্যারাসুটের দড়ির কী সম্পর্ক, প্যারাসুটের দড়িটা কোথায় পেঁচিয়ে গেল, কেন সেটা হাসাহাসির ব্যাপার, আর সত্যি যদি হাসাহাসির ব্যাপার হয় তা হলে ক্যাপ্টেন ডাবলুর আব্বা–আম্মা কেন রাগারাগি করলেন শাহনাজ কিছুই বুঝতে পারল। কিন্তু শাহনাজ এই মুহূর্তে সেটা নিয়ে আর কথা বাড়াল না। বলল, চল তা হলে যাই।
ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, তুমি একটু দাড়াও, আমি বাসা থেকে আমার টেস্টিং প্যাক নিয়ে আসি।
টেষ্টিং প্যাক?
হ্যাঁ।
কী আছে তোমার টেষ্টিং প্যাকে?
টেষ্ট করতে যা যা লাগে। মাল্টিমিটার থেকে শুরু করে বাইনোকুলার। বাইরে গেলে আমি সাথে নিয়ে যাই।
ঠিক আছে তা হলে, তুমি নিয়ে আস। আমিও রেডি হয়ে নিই।
শাহনাজও তার ব্যাগটা নিয়ে নেয়। ক্যাপ্টেন ডাবলুর মতো পুরোপুরি টেস্টিং প্যাক তার নেই, কিন্তু খাবার জন্য দুই–একটা স্যান্ডউইচ, বিস্কুটের প্যাকেট, কয়েকটা কমলা, বোতল ভরা পানি, ছোট একটা তোয়ালে, মাথাব্যথার ওষুধ, এন্টিসেপটিক টেপ এবং ছোট একটা নোটবই আর পেন্সিল নিয়ে নিল।
কিছুক্ষণের মাঝেই ক্যাপ্টেন ডাবলু এসে হাজির হল। তার টেষ্টিং প্যাক দেখে শাহনাজের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। বিশাল একটা ব্যাক প্যাক একেবারে নানা জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা! জিনিসপত্রের ভারে ক্যাপ্টেন ডাবলু একেবারে কুজো হয়ে গেছে, একটা মোটা লাঠি ধরে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, এতবড় বোঝা নিয়ে তুমি কেমন করে যাবে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, যেতে পারব। আস্তে আস্তে যেতে হবে। পাওয়ার আর এনার্জির ব্যাপার। অল্প করে পাওয়ার বেশি সময় ধরে খরচ করলেই হবে।
এক কাজ করা যাক, তোমার কিছু জিনিস আমার ব্যাগের ভিতর দিয়ে দাও।
না, না। আমার সব টেষ্টিং যন্ত্রপাতি এক জায়গায় থাকুক।
শাহনাজ শুনেছে বিজ্ঞানীরা নাকি নিজেদের যন্ত্রপাতি নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে হয় তাই সে আর জোর করল না। বলল, ঠিক আছে। তুমি কিছুক্ষণ নাও, তারপর আমি নেব।
ক্যাপ্টেন ডাবলুর কথাটা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। সত্যিই তারা দেখতে দেখতেই পৌঁছাল। নির্জন পথটায় এত সুন্দর ছোট ছোট টিলা, গাছপালা, ফুল, লতাপাতা যে তার সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেল। ক্যাপ্টেন ডাবলুর টেস্ট প্যাকটা দুজনে মিলে টেনে নিতে গিয়ে অবশ্য একেবারে কালো ঘাম ছুটে গেল। ঝরনার কাছাকাছি। পৌঁছানোর অনেক আগেই ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। সে মাথা নেড়ে বলল, শাহনাজ আপু, তুমি ঠিকই বলেছ। ঝরনাটা নেই। ঝরনা থাকলে এখান থেকে শব্দ শোনা যেত।
তারা আরো কাছে এগিয়ে যায়, জায়গাটা ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে উঠেছে। আশপাশে অনেক ফার্ন এবং শ্যাওলা। ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, ঝরনার পানির জন্য এখানে স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে তো, তাই এখানে এ রকম গাছ হয়েছিল। দেখেছ, শ্যাওলাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে?
ক্যাপ্টেন ডাবলুর টেস্ট প্যাক টেনে টেনে শাহনাজ শেষ পর্যন্ত একটা ফাঁকা। জায়গায় এসে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন ডাবলু দাঁড়িয়ে সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, শাহনাজ আপু, এই যে এখানে ঝরনাটা ছিল। ঐ উপর থেকে ঝরনার পানি এসে পড়ত। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা জিনিস জান? সামনের পাহাড়টা অনেক উঁচু হয়ে গেছে!
শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, পাহাড় উঁচু হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। আগেরবার মেপেছিলাম, এটা ছিল এক শ তেপ্পান্ন মিটার উঁচু। এখন মেপে দেখি কত হয়?
ক্যাপ্টেন ডাবলু তার টেস্ট প্যাক খুলে সেখান থেকে জ্যামিতি বাক্সের চাঁদা লাগানো একটা জিনিস বের করল, একটা টেপ দিয়ে পাহাড়ের গোড়া থেকে কিছু মাপামাপি করল, তারপর তার উচ্চতা মাপার যন্ত্রটা চোখে লাগিয়ে একটা কিছু মেপে কাগজে হিসাব করতে শুরু করল। শাহনাজ বুঝতে পারল ত্রিকোণোমিতি ব্যবহার করে উচ্চতা মাপছে–সে নিজেও মনে মনে হিসাব করতে থাকে, কিন্তু তার আগেই ক্যাপ্টেন ডাবলু ঘোষণা করল, দুই শ এগার মিটার। তার অর্থ পাহাড়টা আটান্ন মিটার উঁচু হয়ে গেছে! ঝরনার পানি আসবে কেমন করে!
একটা পাহাড় উঁচু হয়ে যায় কেমন করে? শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, পাহাড় তো আর গরু বাছুর না যে আগে বসে ছিল এখন উঠে দাঁড়িয়েছে।
ক্যাপ্টেন ডাবলু মুখ গম্ভীর করে বলল, ভূমিকম্প হলে হয়।
এখানে কি কোনো ভূমিকম্প হয়েছে?
হয় নাই। হলেও সেটা রিক্টর স্কেলে পাঁচের কম। আমার ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র রিক্টর স্কেলে পাঁচের কম ভূমিকম্প মাপতে পারে না।
শাহনাজ আবার মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রিক্টর স্কেলটা কী সেটা সম্পর্কে তার ভাসা–ভাসা একটা ধারণা আছে অথচ এই ছেলে নাকি রিক্টর স্কেলে ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছে! পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে শাহনাজ বলল, ভাইয়া বলেছিল এখানে নাকি একটা স্পেসশিপ নেমেছে। কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না।