সেটার আমি কী জানি? তোকে এখানে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল, পৌঁছে দিয়ে গেছি। ব্যস আমার কাজ শেষ।
শাহনাজ রাগের চোটে কী বলবে বুঝতে পারল না। অনেক কষ্ট করে বলল, ভাইয়া, এখানে আর কেউ নেই। চাচা–চাচি কবে আসবে আমি কিছু জানি না–
তোর সমস্যাটা কী? বাসায় কাজের মানুষ আছে, বুয়া আছে, তোকে দেখেশুনে রাখবে।
ঐ পাহাড়ে গিয়ে তোমার কোনো বিপদ–আপদ হয় কি না সেটা কীভাবে বুঝব?
হবে না।
যদি হয় তা হলে তো জানতেও পারব না।
ইমতিয়াজ মুখ ভেংচে বলল, আমার জন্য তোর যদি এত দরদ তা হলে ঢাকায় ফোন করে খোঁজ নিস।
এই চা–বাগানের ফোন কাজ করে না, কিছু না–
ইমতিয়াজ ধমক দিয়ে বলল, এখন আমি তোর জন্য এখানে মোবাইল ফোনের অফিস বসাব নাকি?
কাজেই ইমতিয়াজ দুপুরবেলা পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা দিল। যাবার আগে শেষ কথাটি ছিল বিবিসি টেলিভিশনটা ধরে রাখতে। পরদিন সেখানে তাকে নাকি দেখা যাবে।
.
রাতটা শাহনাজ একটু দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটাল। ইমতিয়াজ বিখ্যাত হয়ে কোটি কোটি ডলারের মালিক হয়ে গেলে তার কোনো আপত্তি নেই। এক বাসায় থাকতে হলে হয়তো জীবনটা বিষাক্ত করে দিত, কিন্তু নিজেই বলেছে আমেরিকা গিয়ে থাকবে, কাজেই একদিক দিয়ে ভালোই। কিন্তু একা একা কোনো পাহাড়ে গিয়ে, কি স্পেসশিপের ছবি তুলে ফিরে যেতে যদি কোনো বিপদে পড়ে, কেউ তো জানতেও পারবে না। শাহনাজ স্বীকার করছে। তার এই ভাইয়ের জন্য বুকের মাঝে ভালবাসার বান ছুটছে না, কিন্তু সবকিছু নিরাপদ আছে–মনের শান্তির জন্য এইটুকু তো জানা দরকার।
সকালে উঠে সে ঢাকায় তাদের বাসায় ফোন করার চেষ্টা করল, কিন্তু চা–বাগানের টেলিফোন কানেকশন কিছুতেই বাগান থেকে বের হতে পারল না। কী করবে সে ভেবে পাচ্ছিল না। বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে বসে চিন্তা করছে, তখন হঠাৎ সে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে দেখতে পেল, লম্বা লোহার মতো একটা জিনিসের আগায় চ্যাপ্টা থালার মতো একটা জিনিস লাগানো, একপাশে একটা ছোট বাক্সের মতো, সেখান থেকে কিছু তার হেডফোনে এসে লেগেছে, গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা শুনতে শুনতে হেঁটে যাচ্ছে। শাহনাজ উঠে দাঁড়িয়ে ডাকল, ক্যাপ্টেন ডাবলু।
প্রথম ডাকে শুনতে পেল না, দ্বিতীয় ডাকে ঘুরে শাহনাজের দিকে তাকাল। তাকে দেখে খুশি হয়ে সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, শাহনাজ আপু! এই দেখ মেটাল ডিটেক্টর তৈরি করেছি।
মেটাল ডিটেক্টর? কী হয় এটা দিয়ে?
মাটির নিচে কোনো গুপ্তধন থাকলে খুঁজে বের করে ফেলব।
খুঁজে পেয়েছ কিছু?
এখনো পাই নাই, দুইটা পেরেক আর একটা কৌটার মুখ পেয়েছি।
কথা বলতে বলতে শাহনাজ বারান্দা থেকে নেমে রাস্তায় ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে তার একটা কথা মনে হল, ক্যাপ্টেন ডাবলুকে নিয়ে সে কি ঝরনার কাছে রহস্যময় স্পেসশিপটা দেখে আসতে পারে না?
ক্যাপ্টেন ডাবলু কান থেকে হেডফোন খুলে তার মেটাল ডিটেক্টরের সুইচ অফ করে জিজ্ঞেস করল, শাহনাজ আপু, তুমি আর কত দিন আমাদের চা–বাগানে থাকবে?
শাহনাজ ইতস্তত করে বলল, আমি আসলে জানি না। আমি তো সোমা আপুর কাছে বেড়াতে এসেছিলাম কিন্তু সেই সোমা আপুই হাসপাতালে। আমি এখানে থেকে কী করব?
ক্যাপ্টেন ডাবলু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হল না, তবে সে বেশি মাথা ঘামাল না, মাথা নেড়ে বলল, যদি চলেই যাও তা হলে এখানে দেখার মতো যেসব জিনিস আছে সেগুলো দেখে যাও।
কী আছে দেখার মতো?
ফ্যাক্টরিটা দারুণ। গ্যাস দিয়ে যে হিটার তৈরি করেছে সেটা একেবারে জেট ইঞ্জিনের মতো। ইস্! আমার যদি একটা থাকত!
থাকলে কী করতে?
কত কী করা যেত। একটা হোভার ক্র্যাফটই কাতাম।
আর কী আছে দেখার মতো?
ক্যাপ্টেন ডাবলু একটু চিন্তা করে বলল, বাগানের একপাশে একটা ছোট নদীর মতো আছে, তার পাশে একটা পেট্রিফাইড উড আছে। বিশাল গাছ ফসিল হয়ে আছে। আমি একটুকরা ভেঙে এনেছি, কার্বন ডেটিং করতে পারলে কত পুরোনো বের করতে পারতাম।
শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর সব ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু সেটা আর প্রকাশ করল; জিজ্ঞেস করল, এখানে আর কী কী দেখার আছে? একটা নাকি ঝরনা আছে?
হ্যাঁ একটা ঝরনা আছে। এক শ তেপ্পান্ন মিটার উপর থেকে পানি পড়ছে।
এক শ তেপ্পান্ন?
হ্যাঁ আমি মেপেছি।
শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুকে একনজর দেখে বলল, তুমি জান সেই ঝরনাটা অদৃশ্য হয়ে গেছে?
ক্যাপ্টেন ডাবলু অবাক হয়ে শাহনাজের দিকে তাকাল, অদৃশ্য হয়ে গেছে!
হ্যাঁ। আমার ভাই দেখতে গিয়েছিল, যেখানে ঝরনাটা ছিল সেখানে ঝরনাটা নাই।
অসম্ভব। ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, এই ঝরনাটায় সারা বছর পানি থাকে।
বলা ঠিক হবে কি না শাহনাজ বুঝতে পারল না, কিন্তু না বলেও পারল না, গলা নামিয়ে বলল, ঐ ঝরনার কাছে নাকি একটা স্পেসশিপ পাওয়া গেছে।
স্পেসশিপ নিয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে একটুও উত্তেজিত হতে দেখা গেল না। সে মনে মনে কী একটা হিসাব করে বলল, প্রতি সেকেন্ড প্রায় ষোল শ কিউবিক ফুট পানি আসে। এত পানি যদি ঝরনা দিয়ে না এসে অন্য কোথাও যায়, সেখানে পানি জমে যাবে! ঝরনা। বন্ধ হতে পারে না।
কিন্তু স্পেসশিপ
পৃথিবীতে কমিউনিকেশান্স এত ভালো হয়েছে যে কারো চোখকে ফাঁকি দিয়ে এখানে স্পেসশিপ আসতে পারবে না। যদি সত্যি সত্যি এখানে স্পেসশিপ এসে হাজির হয় তা হলে সারা পৃথিবী থেকে সায়েন্টিস্টরা হাজির হবে।