রুখ পাহাড়ি পথে একটু উপরে উঠে আসে, পিছনে বহুদূরে মানুষের বসতিটি এখন গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। এই এলাকাটি খানিকটা সমতল, গাছপালা বলতে গেলে নেই, ভালো করে তাকালে মেতসিসের প্রযুক্তির চিহ্ন দেখা যায়। আরো খানিকটা সামনে এসে রুখ একটা খাড়া দেয়ালের কাছে দাঁড়াল। দেয়ালে বড় বড় করে লেখা জৈবজগতের সীমানা–তার নিচে একটু ছোট করে লেখা সীমানা অতিক্রম বিপজ্জনক।
রুখ দাঁড়িয়ে গেল, জৈবজগতের সীমানা অতিক্রম করা কেন বিপজ্জনক সেটি এখানে লেখা নেই কিন্তু রুখ জানে এই দেয়ালের ওপর দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী অবলাল লেজার রশ্মি চলে গিয়েছে। কেউ যদি নিজেঁ নিজে দেয়ালটি অতিক্রম করার চেষ্টা করে মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। জৈবজগৎটি এনরয়েডের জগৎ থেকে এত সাবধানে কেন আলাদা করে রাখা হয়েছে কে জানে।
রুখ এদিক–সেদিক তাকিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল, সূর্য ঠিক মাথার উপরে উঠে এসেছে এখন। নিও পলিমারের হুডটা মাথার উপর টেনে দিয়ে সে উপরের দিকে তাকাল এবং বহুদূরে বিন্দুর মতো স্কাউটশিপটাকে দেখতে পেল। প্রায়। নিঃশব্দে সেটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। ঠিক কেন জানে না কিন্তু রুখ হঠাৎ করে তার পেটের মাঝে বিচিত্র এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে।
০৪. আসবাবপত্রহীন ছোট একটি ঘরে
আসবাবপত্রহীন ছোট একটি ঘরে রুথ অপেক্ষা করছে। স্কাউটশিপের পাইলট–রসকসহীন, নির্লিপ্ত এবং কথা বলতে অনিচ্ছুক একটি রোবট তাকে এখানে পৌঁছে দিয়ে গেছে। রুখ ঘরের দেয়াল, ছাদ এবং মেঝে ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে একটা দরজা খুলে গেল এবং সেখানে প্রায় মানুষের আকৃতির একটা এনরয়েড উঁকি দিল। রুখের বুকের মাঝে হঠাৎ রক্ত ছলাৎ করে ওঠে–এইটি কি বুদ্ধিমত্তায় মানুষ থেকেও দুই কিংবা তিন মাত্রা উপরের স্তরের?
এনরয়েডটি ঘরের ভিতরে ঢুকে রুখের কাছাকাছি এসে অনেকটা যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বুদ্ধিমত্তায় উপরের স্তরের হলেও এনরয়েডটির চলাফেরার ভঙ্গিটি পুরোনো ধাচের। রুখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে থাকে, মাথার কাছে দুটি ফটোসেলের চোখ, সেখানে বুদ্ধিমত্তার কোনো চিহ্ন নেই।
এনরয়েডটি রুখের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের যান্ত্রিক গলায় বলল, তোমার কাপড় জামা খুলে টেবিলটাতে শুয়ে পড়।
কাপড়–জামা খুলে? মানে সবকিছু খুলে?
হ্যাঁ। এখানে আর কেউ নেই। তোমার লজ্জা পাবার কিছু নেই। আমি যন্ত্র। মানুষ যন্ত্রের সামনে লজ্জা পায় না।
রুখ কাপড় খুলতে খুলতে হঠাৎ লজ্জা নামক সম্পূর্ণ মানবিক এই ব্যাপারটি কীভাবে কাজ করে বোঝার চেষ্টা করল কিন্তু তার সময় পেল না। কারণ তার আগেই এনরয়েডটি শীতল হাত দিয়ে তার পাজরে স্পর্শ করে কিছু একটা দেখতে শুরু করেছে। রুখ কষ্ট করে নিজেকে স্থির রেখে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমরা পাইয়ের মান দশমিকের পর কত ঘর পর্যন্ত বলতে পার?
বারো।
বারো? রুখ অবাক হয়ে বলল, মাত্র বারো? আমিই তো বারো থেকে বেশি বলতে পারি!
আমার যে ধরনের কাজকর্ম করতে হয় তাতে দশমিকের পর বারো ঘরের বেশি প্রয়োজন হয় নি।
কিন্তু কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি শুনেছি তোমরা কয়েক মিলিয়ন পর্যন্ত বলে যেতে পার।
ভুল শুনেছ। আমরা পারি না। এনরয়েডটি রুখকে ছোট একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, টেবিলটাতে শুয়ে পড়।
রুখ টেবিলটাতে শুয়ে পড়ে এনরয়েডটার দিকে তাকাল, সেটি উপর থেকে কিছু যন্ত্র নিচে টেনে নামাতে থাকে। রুখের বুকের উপর চতুষ্কোণ এবং মসৃণ একটি মনিটর বসিয়ে এনরয়েডটি বলল, তুমি এখন জোরে জোরে নিশ্বাস নাও।
রুখ কয়েকবার জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়, সাথে সাথে আশপাশে কয়েকটা যন্ত্রের ভেতর থেকে নিচু কম্পনের কিছু ভোঁতা শব্দ শুনতে পায়। এনরয়েডটি হেলমেটের মতো দেখতে একটি গোলাকার জিনিস তার মাথার মাঝে লাগাতে থাকে। রুখ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে এনরয়েডটি লক্ষ করতে করতে বলল, তুমি কী করছ?
মানুষের বসতি থেকে কেউ এলে তাদের পরীক্ষা করতে হয়। জিনেটিক মিউটেশান কী পর্যায়ে আছে সেটি লক্ষ রাখতে হয়। এগুলো রুটিন কাজ, তোমার ভয় পাবার কিছু নেই।
আমি–আমি আসলে ঠিক ভয় পাচ্ছি না–
পাচ্ছ। আমি জানি তোমার শরীরের সমস্ত অনুভূতি আমার সামনে মনিটরে দেখানো হচ্ছে। আমার কাছ থেকে তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। আমি তোমার মতো একজন।
আমার মতো?
হ্যা আমার বুদ্ধিমত্তা মানুষের সমান। নিনীষ স্কেলে আট।
তুমি তুমি এখানে কী করছ? আমি ভেবেছিলাম নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে সব এনরয়েড আমাদের থেকে বুদ্ধিমান।
না সবাই নয়। রুটিন কাজ করার জন্যে আমাদের মতো অনেকে আছে। এখন কথা বোলা না, তোমার প্রিয় কোনো জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে থাক।
কেন?
তোমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করা হচ্ছে।
মস্তিষ্ক কীভাবে স্ক্যান করে?
খুব সোজা। কিছু ইলেকট্রড তোমার করোটিকে স্পর্শ করে। উচ্চ কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ সেই ইলেকট্রড দিয়ে তোমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তার প্রতিফলিত আবেশ রেকর্ড করা হয়।
কী লাভ তাতে?
সেই স্ক্যান দেখে তোমার সম্পর্কে সবকিছু জানা যাবে। তুমি কী জান, তুমি কীভাবে চিন্তা কর সবকিছু।
কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?
তোমার কিংবা আমার জন্য সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু যাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে দুই মাত্রা উপরে তারা পারে। কাজেই তুমি কথা না বলে চুপ করে শুয়ে থাক। সুন্দর কিছু একটা ভাব।