রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি ভয় দেখাচ্ছি না, সত্যি কথা বলছি। ব্যাপারটি জানা থাকা ভালো–বিপদ কম হবে।
রুখ চিন্তিত মুখে বলল, তুমি যাদের দেখেছ তাদের বুদ্ধিমত্তা কত ছিল?
তিন কিংবা চার।
এর থেকে বড় বুদ্ধিমত্তার কিছু নেই?
আছে–তারা আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষের সামনে আসবে না। শুনেছি তারা দেখতেও অন্যরকম। হাত–পা নেই–শুধু কপোট্রন আর সেন্সর নিনীষ স্কেলে তারা এক কিংবা দুই।
এর থেকে উপরে কিছু নেই?
জানি না। যদি থাকে সেটা আমরা কখনো কল্পনা করতে পারব না। হয়তো অসংখ্য কপোট্রনের একটা অতিপ্রাকৃত সমন্বয়
রুখ কোনো কথা না বলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বুদ্ধিমত্তার এই যে স্কেল তুমি সেটা বিশ্বাস কর?
রুহান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সেটা নির্ভর করে বুদ্ধিমত্তাকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা কর তার উপর। তুমি যদি মনে কর পাইয়ের মান কয়েক ট্রিলিয়ন সংখ্যা পর্যন্ত বলে যাওয়া হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা তা হলে আমি নিনীষ স্কেলে বিশ্বাস করি। যদি মনে কর রেটিনার কম্পন দেখে নিউরনের সিনালের মাঝে সংযোগ স্থাপনের নিখুঁত হিসাব বলে দেওয়া হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা– যা তা হলেও আমি নিনীষ স্কেলে বিশ্বাস করি। কিন্তু
কিন্তু?
কিন্তু বুদ্ধিমত্তার অর্থ যদি হয় মিলিয়ন মিলিয়ন বছর টিকে থাকা তা হলে আমি জানি নিনীষ স্কেল সত্যিকারের স্কেল কি না। আমাদের কাছে তার কোনো প্রমাণ নেই।
রুহান
বল।
এই যে মেতসিস একটা বিশাল মহাকাশযান–অসংখ্য বুদ্ধিমান এনরয়েডদের সাথে আমরা মহাকাশে ভেসে যাচ্ছি, তোমার কি কখনো মনে হয় না এর প্রকৃত উদ্দেশ্য কী আমরা জানি না
রুহান হেসে বলল, এই ধরনের দার্শনিক তত্ত্বকথা নিয়ে আলোচনা করার সময় এটা নয়। তুমি ঘুমাও, আগামীকাল তোমার জন্য একটা কঠিন দিন, ঘুমিয়ে সুস্থ সতেজ হয়ে থাক।
রুখ দুর্বলভাবে হেসে বলল, কিন্তু ঘুমাতে পারছি না!
পারবে। মানুষের যেটি সবচেয়ে বড় দুর্বলতা সেটি আসলে তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। একটি অত্যন্ত কঠিন পরিবেশ থেকে এনরয়েড সরে আসতে পারে না, মানুষ পারে। রুখ একমুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, মানুষ ইচ্ছে করলে মারা যেতে পারে।
রুখ হো হো করে হেসে বলল, তুমি আসলে আমাকে মারা যাওয়ার লোভ দেখাচ্ছ?
খানিকটা দেখাচ্ছি!
রুহান! তা হলে তোমার আমাকে সাহস দিতে হবে না–আমি নিজেই ব্যবস্থা করে নেব।
রুহান রুখের কাঁধ স্পর্শ করে কোমল গলায় বলল, আমি জানি তুমি পারবে। আমি শুধু বলতে এসেছি তুমি কখনো একা নও–আমরা সবাই একসাথে আছি।
বিছানায় শুয়ে রুখ হঠাৎ করে ভাবল রুহান আসলে সত্যি কথাই বলেছে। আগামীকাল কী হবে জানে না কিন্তু যেটাই হোক সেটা তো মৃত্যু থেকে খারাপ কিছু হতে পারে না। আর মৃত্যু যে খুব খারাপ সেটি কি কেউ প্রমাণ করে দেখিয়েছে?
.
রুখ মানুষের বসতি থেকে বের হবার আগে তার সাথে অনেকে দেখা করতে এল। সবাই এমনভাবে কথা বলছিল যেন সে তাদের খাবার সংশ্লেষণযন্ত্রের বয়লার আনতে যাচ্ছে–যেন ব্যাপারটি খুবই স্বাভাবিক, যেন এটি একটি দৈনন্দিন ব্যাপার। মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে বুদ্ধিমান এনরয়েডদের সাথে দেখা করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই যে কেউ আর। কখনো ফিরে আসে না সেটি কেউ একবারও উচ্চারণ করল না। রুথ নিজেও পরিবেশটুকু স্বাভাবিক রাখল, হালকা রসিকতা করল, নিজের পোশাক নিয়ে কিছু মন্তব্য করল। একসময় রুহান রুখের পিঠে হাত দিয়ে বলল, রুখ রওনা দিয়ে দাও। অনেকদূর যেতে হবে।
হ্যা যাই। রুখ তখন ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রীনা, যাচ্ছি।
ক্রীনা, মেতসিসের সবচেয়ে তেজস্বী মেয়ে, যার জন্য রুখ সবসময় নিজের ভিতরে এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করে এসেছে–একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, সাবধানে থেকো।
রুখ একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, থাকব ক্রীনা। তার খুব ইচ্ছে করছিল সে একবার ক্রীনার মাথায় হাত বুলিয়ে তার চোখে চোখ রেখে কিছু একটা বলে–কিন্তু সে কিছু করল না। পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে গেট খুলে বের হয়ে এল। অনেকটা পথ তাকে হেঁটে যেতে হবে– পৃথিবীর অনুকরণ করে এখানে গাছপালা বনজঙ্গল পাথর ঝরনা তৈরি করা হয়েছে, হাঁটতে ভালোই লাগে। জৈবজগতের সীমারেখায় পৌঁছানোর পর কোনো একটি রোবটযান তাকে তুলে নেবে, তাকে সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে রুখ একবার পিছন ফিরে তাকাল, বসতির গেট ধরে ক্রীনা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, বাতাসে তার নিও পলিমারের কাপড় উড়ছে। কী বিষণ্ণ পুরো দৃশ্যটি! রুথ হঠাৎ ভিতরে ভিতরে শিউরে ওঠে, সত্যি যদি সে আর কখনো ফিরে না আসে? মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে এনরয়েডদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অনেকেই তো ফিরে আসে নি। সে যদি আর কখনো ক্রীনাকে দেখতে না পায়? রুখ বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিল।
পাহাড়ি পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুখ হাত দিয়ে আড়াল করে সূর্যের দিকে তাকাল, এখনো এটা দিগন্তের কাছাকাছি আছে, আরো কিছুক্ষণের মাঝে মাথার উপরে উঠে আসবে। রুখ তথ্যকেন্দ্রে দেখেছে পৃথিবী তার অক্ষের উপরে ঘুরত বলে সেখানে মনে হত সূর্য দিগন্তের একপাশ থেকে উদয় হয়ে অন্যপাশে অস্ত যাচ্ছে। মেতসিসেও অনেকটা সেরকম করার চেষ্টা করা হয়েছে। চৌম্বক ক্ষেত্রে একটা প্লাজমা আটকে রেখে সেখানে খুব নিয়ন্ত্রিত একটা থার্মোনিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চালু রাখা হয়েছে। সেটা ধীরে ধীরে একপাশ থেকে শুরু হয়ে অন্যপাশে হাজির হয়, মেতসিসের ভিতর থেকে মনে হয় বুঝি আকাশের এক প্রান্তে উদয় হয়ে অন্য পাশে সূর্য অস্ত গিয়েছে। পৃথিবীর মতো পুরো সময়টা কয়েকটা ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে, কোনো ঋতু উষ্ণ কোনো ঋতু শীতল। পৃথিবীর মতোই মাঝে মাঝে এখানে ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে, নির্দিষ্ট একটা সময়ে উপরে মেঘ জমা হয় এমনকি মাঝে মাঝে একপসলা বৃষ্টি পর্যন্ত হয়। শুধুমাত্র যে জিনিসটি এখানে নেই সেটি হচ্ছে আকাশ। পৃথিবীর মানুষ উপরে তাকালে দেখতে পেত আদিগন্তবিস্তৃত সীমাহীন নীল আকাশ। এখানে এক শ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বিশাল গোলকের মাঝে থেকে উপরের দিকে তাকালে আকাশ নয়– আবছা আবছাভাবে গোলকের অন্য পৃষ্ঠ, বুদ্ধিমান এরয়েডের বসতি দেখা যায়। মহাকাশব্যাপী বিশাল আদিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশের দিকে তাকাতে কেমন লাগে রুখ জানে না। তার ধারণা সেটি নিশ্চয়ই একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা যার কোনো তুলনা নেই। সে তথ্যকেন্দ্রে দেখেছে বুদ্ধিমান এনরয়েডদের বসতি থেকে মেতসিসের বাইরে, মহাকাশের দিকে তাকানো যায়, সেখানে নিকষ কালো অন্ধকার আকাশের নক্ষত্র–নীহারিকা দেখা যায়। যদি কখনো সুযোগ হয় কুখ নিশ্চয়ই একবার দেখবে সীমাহীন মহাকাশের দিকে একটিবার চোখ খুলে তাকিয়ে দেখতে না জানি কেমন অনুভূতি হবে!