প্রয়োজন হলে করতে হবে।
মহাকাশকেন্দ্রের পরিচালক একটু ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, এই মহাকাশযানটি তৈরি করা হাজার গুণ বেশি কঠিন হয়ে গেল মহামান্য ক্লাউস ট্রিটন।
সেটি সম্ভবত সত্যি।
ত্রাশিয়ান এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল, এবারে ক্লাউস ট্রিটনের অনুমতি নিয়ে বলল, মহামান্য ক্লাউস। এই মহাকাশযানটি মহাকাশে তার অনির্দিষ্ট যাত্রা শুরু করার কয়েক দশকের মাঝেই সকল মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ক্লাউস ট্রিটন বললেন, আমি সে ব্যাপারে তোমার মতো নিশ্চিত নই।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত। মহাকাশযানের এনরয়েডরা যখন আবিষ্কার করবে নিনীষ স্কেলে বুদ্ধিমত্তা আট একধরনের জৈবিক প্রাণীকে রক্ষা করার জন্য মহাকাশকেন্দ্রের বিশাল শক্তিক্ষয় হচ্ছে তখন তারা সেই প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো অর্থ খুঁজে পাবে না। মহাকাশযানে মানবজাতি আবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
তবুও আমাদের এই মহাকাশযানের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ত্রাশিয়ান।
কেউ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। মহাকাশকেন্দ্রের পরিচালক তার যান্ত্রিক চক্ষুকে প্রসারিত করে বললেন, এই মহাকাশযানের নামকরণ কি করা হয়েছে মহামান্য ক্লাউস?
হ্যাঁ। আমরা এটিকে ডাকব মেতসিস।
মেতসিস? এর কি কোনো অর্থ আছে?
না। এখন এর কোনো অর্থ নেই। কিন্তু হয়তো কখনো এর একটি অর্থ হবে। মেতসিস শব্দটি হয়তো কোনো একটি বিশেষ প্রক্রিয়া হিসেবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে স্থান করে নেবে। এখন কেউ সেটি বলতে পারে না।
বিজ্ঞান একাডেমির সভা শেষে সবাই চলে গেলে ত্রাশিয়ান ক্লাউস ট্রিটনের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, মহামান্য ক্লাউস
বল।
এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। মানুষ তার দায়িত্ব পালন করেছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বুদ্ধিমত্তার জন্ম দিয়েছে। এখন সেই বুদ্ধিমত্তার পরিপূর্ণতা করতে হবে আমাদের। মানুষ আর। কখনো পারবে না।
তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ ত্রাশিয়ান। তবে—
তবে কী?
হয়তো বুদ্ধিমত্তাকে পরিপূর্ণ করা সৃষ্টিজগতের উদ্দেশ্য নয়। হয়তো সৃষ্টিজগতের উদ্দেশ্য
উদ্দেশ্য কী?
আমি জানি না।
ত্রাশিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনি জানেন, কিন্তু বলতে চাইছেন না!
বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি ক্লাউস ট্রিটন ত্রাশিয়ানের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
০৩. রুখ গোল জানালাটি খুলতেই
রুখ গোল জানালাটি খুলতেই ভিতরে একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঢুকল। নিও পলিমারের কাপড়টি গায়ে জড়িয়ে সে বাইরে তাকাল, চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, কোথাও কোনো শব্দ নেই, কেমন জানি এক ধরনের মন–বিষণ্ণ–করা নীরবতা। রুখ মাথা বের করে উপরে তাকাল–উপরে মেতসিসের অন্য পাশে মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র, খুব ভালো করে লক্ষ করলে মাঝে মাঝে সেটা দেখা যায়। রুখ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল এবং হঠাৎ করে সেটা দেখতে পেল। সাথে। সাথে সে কেমন যেন শিউরে ওঠে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে আগামীকাল এই নিয়ন্ত্রণকক্ষে বুদ্ধিমান এনরয়েডদের মুখোমুখি হবে।
রুখ একটা নিশ্বাস ফেলে ঘরের ভেতরে মাথা ঢোকাতেই শুনতে পেল কেউ একজন দরজায় শব্দ করছে। রুখ এসে দরজা খুলতেই দেখতে পেল রুহান দাঁড়িয়ে আছে, একটু অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার রুহান, তুমি?
রুহান মধ্যবয়স্ক হাসিখুশি মানুষ, দীর্ঘদিন সে মানুষের এই আস্তানাটিতে কেন্দ্র পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছে। রুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, আমিও একই জিনিস জিজ্ঞেস করতে এসেছি! কী ব্যাপার তুমি
আমি কী?
তুমি এখনো ঘুমাও নি? কত রাত হয়েছে জান?
চেষ্টা করছিলাম, ঘুম আসছে না।
ভয় লাগছে?
অন্য কেউ হলে রুখ স্বীকার করত না কিন্তু রুহানের কাছে লুকানোর কিছু নেই, সে মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ
রুহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব ভালো লাগত যদি বলতে পারতাম ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু মিছে বলে লাভ কী? ব্যাপারটি আসলেই ভয়ের।
তুমি তো গিয়েছ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে–বুদ্ধিমান এনরয়েডদের দেখেছ, কেমন লাগে দেখতে?
আসলে বাইরে থেকে দেখে তো সেরকম কিছু বোঝা যায় না। চতুর্থ প্রজাতির প্রতিরক্ষা রোবট আর নিনীষ স্কেলে তিন কিংবা চার বুদ্ধিমত্তার এনরয়েডের বাইরে থেকে বিশেষ পার্থক্য নেই। তবে
তবে কী?
তুমি যখন ওদের সামনে দাঁড়াও হঠাৎ করে যখন মনে হয় পৃথিবীর সকল জীবিত মানুষ মিলে যে বুদ্ধিমত্তা ছিল এই যন্ত্রদের যে কোনো একটির মাঝে সেই একই বুদ্ধিমত্তা তখন কেমন যেন সমস্ত হাত–পা শীতল হয়ে যায়। যখন কথা বলে–_
ওদের গলার স্বর কী রকম?
আমাদের সাথে কথা বলার জন্য মানুষের কণ্ঠস্বরেই কথা বলে, সত্যি কথা বলতে কী গলার স্বর চমৎকার। কিন্তু গলার স্বরটি ব্যাপার নয়। ব্যাপার হচ্ছে তাদের ক্ষমতা কী রকম ক্ষমতা?
ওদের সামনে দাঁড়ালে বুঝতে পারবে তোমার নিজস্ব কোনো সত্তা নেই। তোমার সবকিছু ওরা জানে। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে ওরা সবকিছু বুঝে ফেলে। অনেক মানুষের সামনে উলঙ্গ করে ছেড়ে দিলে তোমার যেরকম লাগবে এটাও সেরকম। তবে এটা আরো ভয়ানক–এটা শারীরিক নগ্নতা নয়–এটা একেবারে নিজের ভিতরের নগ্নতা। কথা বলতে বলতে রুহান হঠাৎ কেমন জানি শিউরে উঠল।
রুখ জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি এমনিতেই ভয়ে ঘুমাতে পারছি –তুমি আরো ভয় দেখিয়ে দিচ্ছ।