কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যদি আমাকে ভালবাস তুমি যদি খুব তীব্রভাবে চাও আমি বেঁচে থাকি তা হলে মহাজাগতিক প্রাণী তোমার ডাকে আমাকে বাঁচাতে আসবে।
রুখ ক্রীনাকে জাপটে ধরে আর্তকণ্ঠে বলল, আমি তোমাকে ভালবাসি। নিজের চাইতেও বেশি ভালবাসি। ক্রীনা, দোহাই তোমার।
ক্রীনার মুখে ক্ষীণ একটা হাসি ফুটে ওঠে, তুমি চাইলে আসবে। আমি জানি।
রুখ ক্রীনার হাত ধরে রক্তের ধারাকে বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। ফিনকি দেওয়া রক্তে তার শরীর রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। সে ভয়ার্ত অসহায় গলায় চিৎকার করে বলল, কী করলে তুমি ক্রীনা? তুমি এ কী করলে? আমি তো চাই তুমি বেঁচে থাক, কিন্তু কেউ তো আসছে না! এখন কী হবে ক্রীনা?
ঠিক তখন কে রুখের কাঁধে হাত রাখল। রুখ চমকে পিছনে ঘুরে তাকাল, সাদা নিও পলিমারের কাপড়ে ঢাকা একজন অপূর্ব সুন্দরী মহিলা তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, দেখি বাছা, আমাকে একটু দেখতে দাও।
রুখ সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে জায়গা করে সরে দাঁড়াল। মহিলাটি ক্রীনার কাছে ঝুঁকে পড়ে, তার রক্তাক্ত হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে কোমল গলায় বলে, পাগলী মেয়ে আমার। এরকম করে কেউ কখনো নিজের হাত কাটে?
ক্রীনা অপলক চোখে এই অপূর্ব সুন্দরী মহিলার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মা! তুমি এসেছ?
এসেছি। কথা বলবি না এখন। চুপ করে শুয়ে থাক দেখি। ইস! কী খারাপভাবে কেটেছে!
ক্রীনা উঠে এসে হাত দিয়ে গভীর ভালবাসায় মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, মা, আমি জানি তুমি আমার কল্পনা। কিন্তু তাতে কিছু আসে–যায় না। আমার কাছে তুমিই আমার সত্যিকারের মা।
আহ! কী বকবক শুরু করলি–একটু স্থির হয়ে শুয়ে থাক দেখি। রক্তটা বন্ধ করা যায় কি না দেখি।
ক্রীনা আবার শুয়ে পড়ল, মহিলাটি তার হাতের উপর ঝুঁকে পড়লেন, নিও পলিমারের একটুকরা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলেন, গভীর স্নেহে ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ইস! যদি একটু দেরি হত তা হলে কী হত?
কেন দেরি হবে মা? তুমি তোমার মেয়েকে বাচাতে আসবে না?
আমার আর অন্য কাজ নেই ভেবেছিস?
আমি তোমাকে আগে কখনো দেখি নি। একসময়ে ভেবেছিলাম দেখেছি কিন্তু পরে জেনেছি সব আমাদের মস্তিষ্কে বসানো কাল্পনিক স্মৃতি। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা বসিয়েছে। তুমি চিন্তা করতে পার আমার কোনো মা নেই? কোনো মাতৃগর্ভে আমার জন্ম হয় নি!
ক্রীনার মা গভীর ভালবাসায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কে বলেছে তোর মা নেই? এই যে আমি। আমি কি তোর মা নই?
হ্যাঁ, মা। তুমি আমার মা।
রূপবতী মহিলাটি এবারে ঘুরে রুখের দিকে তাকালেন, বললেন, বাছা! তোমার এ কী অবস্থা? গায়ে কোনো কাপড় নেই। কালিঝুলি মেখে আছে!
রুখ হতচকিতের মতো মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। মহাজাগতিক প্রাণী ক্রীনা কল্পনা থেকে এই অপূর্ব সুন্দরী মাতৃমূর্তিকে তৈরি করেছে। এটি সত্যি নয় কিন্তু তার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল যে এটি সত্যি। সে ইতস্তত করে বলল, একটা দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম, গোলাগুলির বিস্ফোরণে
ক্রীনার মা নিজের শরীর থেকে একটুকরা নিও পলিমারের চাদর খুলে রুখের গায়ে জড়িয়ে দিলেন, সাথে সাথে তার সারা শরীরে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। তিনি রুখের মাথায় হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, আমার এই পাগলী মেয়েটিকে তুমি দেখে রাখবে তো বাছা?
রাখব। রাখব মা।
ক্রীনা অপলক দৃষ্টিতে তার ক্ষণকালের মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে তার বুকের ভিতরে এক ধরনের গভীর বেদনা অনুভব করে। তার মা তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, কিছু ভাবিস না মা সব ঠিক হয়ে যাবে।
মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি কি তোর সাথে মিছে কথা বলব?
কিন্তু কেমন করে সেটা সম্ভব? এই দেখ–রুখের দিকে তাকাও–তার ডি.এন.এ. পর্যন্ত পাল্টে দেওয়া আছে বেস পেয়ার বারোটি। মেতসিসের দিকে তাকাও–বুদ্ধিমান এনরয়েডরা। আমাদের ইচ্ছেমতো তৈরি করে! ইচ্ছেমতো ধ্বংস করে! তুমিই বল এটি কি মানুষের জীবন?
মা মুখ টিপে হাসলেন যেন সে ভারি একটা মজার কথা বলেছে! ক্রীনা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কী হল? তুমি হাসছ কেন? তোমার কি মনে হচ্ছে এটা হাসির ব্যাপার?
না, পাগলী মেয়ে। এটা মোটেই হাসির ব্যাপার নয় কিন্তু তোরা যত ব্যস্ত হচ্ছিস সেরকম তো নয়।
কী বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি। আয় আমার সাথে।
কোথায়?
আয়, গেলেই বুঝতে পারবি।
মা ক্রীনাকে ধরে সাবধানে দাঁড় করিয়ে দিলেন। কীনা এখনো খুব দুর্বল, অন্য পাশে এসে রুখ তাকে ধরল। দুজন দুপাশে ধরে সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে। বড় পাথরটির অন্য পাশে এসেই ক্রীনা এবং রুখ দেখতে পেল পাথরের গায়ে হালকা নীল পরদার মতো স্বচ্ছ একটি মহাজাগতিক দরজা। ঠিক এরকম একটি দরজা দিয়ে রুখ মহাজাগতিক প্রাণীর জগতে প্রবেশ করেছিল। আয়নার মতো স্বচ্ছ পরদার কাছে দাঁড়িয়ে ক্রীনার মা বললেন, তোরা দুজন আয় আমার সাথে।
ক্রীনা বলল, ভয় করছে মা!
পাগলী মেয়ে! ভয়ের কী আছে? আমি আছি না সাথে?
ক্রীনা তার মাকে জড়িয়ে ধরে। সত্যিই তো তার ভয়ের কী আছে? নিজের কল্পনায় তৈরি মা থেকে আপন আর কী হতে পারে এই জগতে? ক্রীনা এক পা এগিয়ে স্বচ্ছ আয়নার মতো হালকা নীল রঙের মহাজাগতিক দরজা স্পর্শ করল। সাথে সাথে মনে হল কিছু একটা যেন প্রবল আকর্ষণে টেনে লি ভিতরে।