তোমার কি মনে হয় না, কাজটি বিপজ্জনক? কিহিতা অন্ত্যন্ত নির্বুদ্ধিতা করেছে, কিন্তু তার নির্বুদ্ধিতা থেকে একটি জিনিস প্রমাণিত হয়েছে। রুখ আসলে রুখ নয়।
কিন্তু আরো একটা জিনিস প্রমাণ হয়েছে।
সেটা কী?
আমি বলব। তোমাদের বলব। কিন্তু তার আগে আমাকে যেভাবেই হোক রুখকে খুঁজে বের করতে হবে। ক্রীনা নিরাপত্তা সেলের মানুষটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, রুখ কোথায় গিয়েছে?
জানি না। শুনেছি সে মানববসতির বাইরের দিকে হেঁটে গেছে।
ক্রীনা দরজা খুলে বাইরে যাবার জন্য দরজায় হাত রাখতেই রুহান এগিয়ে এল, বলল, ক্রীনা।
কী হল?
সেই ভয়ঙ্কর প্রাণীটা এখনো বাইরে রয়েছে। তোমার কি এখন বাইরে যাওয়া ঠিক হবে?
আমার ধারণা সেই ভয়ঙ্কর প্রাণী আমাকে স্পর্শ করবে না।
কেমন করে তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ?
আমি জানি না। কিন্তু এরকম একটা পরিস্থিতিতে ছোট একটা বিশ্বাসকে শক্ত করে আঁকড়ে না ধরলে আমরা বেঁচে থাকব কেমন করে?
ক্রীনা ঘরের দরজা খুলে অন্ধকারে বের হয়ে গেল।
১৪. যেখানে বনাঞ্চল শুরু হয়েছে
রুখ মানববসতির বাইরে, যেখানে বনাঞ্চল শুরু হয়েছে তার গোড়ায় একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে বসেছিল। ক্রীনাকে দেখে সে কোমল গলায় বলল, ক্রীনা! তুমি এসেছ?
হ্যাঁ।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল তুমি আসবে।
অবশ্যই আমি আসব।
তাই আমি এখানে অপেক্ষা করছি। মনে আছে যখন সবকিছু ঠিক ছিল তখন সারা দিন কাজের শেষে আমরা এখানে সময় কাটাতে আসতাম।
মনে আছে।
তোমাকে আমার খুব ভালো লাগত কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলি নি। আমার কেমন জানি সংকোচ হত।
আমি বুঝতে পারতাম।
সবকিছু কেমন জানি হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল।
না। ক্রীনা রুখের কাছে এসে তার হাত স্পর্শ করে বলল, কিছুই শেষ হয় নি।
রুখ একটু অবাক হয়ে বলল, কী বলছ তুমি? তুমি মনে কর এখনো আমাদের। জীবনের কিছু অবশিষ্ট আছে? আমার জীবনের?
আছে। ক্রীনা রুখকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, আছে।
কী বলছ তুমি ক্রীনা? আমার কাছে আসতে তোমার ভয় করছে না? তুমি জান না আমি আসলে মানুষ নই। কিহিতা আর আরো চার জন তৃতীয় মাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে আমাকে হত্যা করতে পারে নি?
আমি জানি।
তা হলে? তা হলে তোমার কেন ভয় করছে না?
কারণ আমি জানি আসলে তুমি রুখ!
রুখ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, না ক্রীনা আমি রুখ না। আমি মহাজাগতিক প্রাণী। তুমি জান না কী ভয়ঙ্কর নৃশংসতায় আমি কিহিতাকে হত্যা করেছি তার সঙ্গীদের হত্যা। করেছি? তুমি জান না আমি কী ভয়ঙ্করদর্শন, কী কুৎসিত? কী নৃশংস। আমি দেখেছি।
না রুখ, আমি তোমাকে সেই কথাটিই বলতে এসেছি।
কী বলতে এসেছ?
ক্রীনা রুখের হাতে চাপ দিয়ে বলল, আমি তোমাকে বলতে এসেছি যে তুমি কাউকে হত্যা কর নি। তারা নিজেদেরকে নিজেরা হত্যা করেছে।
তুমি কী বলছ বুঝতে পারছি না।
তোমার সাথে যে মহাজাগতিক প্রাণী এসেছে সেটি ভয়াবহ নৃশংস নয়।
সেটি তা হলে কী?
আমরা সেটাকে যেরকম কল্পনা করব তারা ঠিক সেরকম। বুদ্ধিমান এনরয়েডদের কাছে এসেছিল ভয়াবহ বিশাল একটি রোবট হিসেবে। তারা যন্ত্র, তাদের চিন্তা–ভাবনাও রোবটকেন্দ্রিক। তারা ধরে নিয়েছে মহাজাগতিক প্রাণী তাদের বন্ধু নয়, তাদের শত্রু, তাই সেই রোবট এসেছিল অস্ত্র হাতে। ঠিক তারা যেরকম কল্পনা করেছে সেরকম। শত্রু হিসেবে এসে সেই রোবট তাদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।
কিহিতাও ভাবত মহাজাগতিক প্রাণী হচ্ছে ভয়ঙ্কর নৃশংস একটা প্রাণী। অতিকায় সরীসৃপের মতো ক্লেদাক্ত তার দেহ। নিষ্ঠুর তার আচরণ তাই তার সামনে সেই প্রাণী এসেছে ভয়ঙ্কররূপে। এসে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেছে। ঠিক যেরকম সে আশঙ্কা করত।
কিন্তু আমি তা ভাবি না। আমার সবচেয়ে যে প্রিয় মানুষটি তাকে তারা নিজেদের কাছে নিয়ে তাকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। বুদ্ধিমান এনরয়েডদের আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করেছে। আমাকে রক্ষা করেছে। কিহিতার নির্বুদ্ধিতা থেকে রক্ষা করেছে। আমি সেই মহাজাগতিক প্রাণীকে কল্পনা করি ভালবাসার কোমল রূপে। আমার মা যেভাবে গভীর ভালবাসায় আমাকে বুকে চেপে বড় করেছে ঠিক সেভাবে। আমার সামনে যদি সেই মহাজাগতিক প্রাণী আসে আমি জানি সে আসবে ভালবাসার কোমল রূপে। আমি জানি।
রুখ অবাক হয়ে ক্রীনার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, তুমি তাই বিশ্বাস কর?
হ্যাঁ। আমি তাই বিশ্বাস করি। তুমি দেখতে চাও সেটি কি সত্যি না মিথ্যা?
রুখ ঘুরে তাকাল। ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যা আমি দেখতে চাই।
তা হলে দেখ।
ক্রীনা তার পোশাকের ভেতর থেকে একটা ধারালো ছোরা বের করে আনে। রুখ কিছু বোঝার আগে হঠাৎ করে সেটা দিয়ে এক পোচ দিয়ে নিজের কবজির কাছে বড় ধমনিটি কেটে ফেলল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এল সাথে সাথে, আর্তচিৎকার করে রুখ ক্রীনার হাত ধরে ফেলল, বলল, কী করলে তুমি? ক্রীনা? কী করলে?
মহাজাগতিক প্রাণীকে আমি আনতে পারি না রুখ! মহাজাগতিক প্রাণীকে শুধু তুমিই আনতে পার। ক্রীনা হাত থেকে গলগল করে বের হতে থাকা রক্তের ধারার দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থেকে বলল, আমাকে যদি এখন যথাযথভাবে চিকিৎসা করা না হয় তা হলে আমি মারা যাব। মানববসতি থেকে আমরা এত দূরে যে সেখানে আমাকে সময়মতো নেওয়া যাবে না।