কিহিতা হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকে এবং ঠিক তখন পিছন থেকে একটি আর্তচিৎকার শুনতে পেল। সে ঘুরে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার সমস্ত শরীর পাথরের মতো জমে গেল। দূরে রুখের বাসার কাছে একটি মহাজাগতিক অতিপ্রাকৃত প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে। রাতে দুঃস্বপ্নের মাঝে যে অশরীরী প্রাণী তাকে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে তাড়া করে বেড়িয়েছে–সেই প্রাণীটিই এখন মূর্তিমান বিভীষিকার মতো দাঁড়িয়ে আছে।
প্রাণীটি দীর্ঘ–তার থেকে আরো একমাথা উঁচু। দেখে মনে হয় কোনো এক ধরনের সরীসৃপ কিন্তু এটি সরীসৃপ নয়। মনে হয় জীবন্ত একটি প্রাণীর চামড়া খুলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাণীটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাইরে প্রকট হয়ে ঝুলছে, সমস্ত দেহটি থিকথিকে আঠালো এক ধরনের তরলে ভেজা। সেই তরল শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে নিচে ঝরছে। শক্তিশালী মাথা, লম্বা মুখ এবং সেখান থেকে সারি সারি ধারালো দাঁত বের হয়ে এসেছে। ছোট ছোট একজোড়া লাল চোখ তীক্ষ্ণ এবং ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুকের কাছাকাছি। একজোড়া হাত, তীক্ষ্ণ নখ, পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের ভারসাম্য রাখার জন্য পিছনে শক্তিশালী লেজ।
প্রাণীটি তার মুখ খোলে এবং সেখান থেকে সকলকে গলিত একটি জিভ বের হয়ে আসে। কিহিতা বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং অবাক হয়ে দেখে বিশাল একটি শরীর নিয়ে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় সেটি তার দিকে ছুটে আসছে। আর্তচিৎকার করে দুই হাত তুলে সে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। প্রাণীটি শক্ত চোয়াল দিয়ে তাকে কামড়ে ধরে মুহূর্তের মাঝে বন্যপশুর মতো ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। বিচিত্র এক ধরনের অশরীরী শব্দ করতে করতে প্রাণীটি অন্যদের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় এবং দ্বিতীয় আরেক জনকে আক্রমণ করে। অমানুষিক আতঙ্কে তারা চিৎকার করতে করতে ছুটে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু প্রাণীটি অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় তাদের আরো এক জনকে ধরে ফেলে। ভয়ঙ্কর। নৃশংসতায় মানুষটির দেহটিকে ছিন্নভিন্ন করে জান্তব শব্দ করতে করতে সেটি অন্য আরেক জনের পিছনে ছুটতে শুরু করে। মানববসতির মাঝে হঠাৎ যেন এক অমানুষিক বিভীষিকা নেমে আসে।
রুখ ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। তার দেহের পোশাক ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে, পুরো দেহ প্রায় নগ্ন। সমস্ত শরীরে মাটি কাদা এবং বিস্ফোরকের কালিঝুলি লেগে আছে। সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়ায়, তারপর ক্লান্ত পায়ে টলতে টলতে হাঁটতে শুরু করে। তার বুকের ভিতরে এক গভীর নিঃসঙ্গতা হাহাকার করতে থাকে।
.
ক্রীনা শক্ত মেঝেতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিল, বিস্ফোরণের শব্দ শুনে চমকে উঠে বসে। ভয়ার্ত মুখে সে রুহানের মুখের দিকে তাকাল। রুহান কাছে এসে ক্রীনার মাথায় হাত রাখে। ক্রীনা রুহানের হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে তারপর দুই হাতে মুখ ঢেকে আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে। রুহান কী করবে বুঝতে পারে না, সে ক্রীনাকে দুই হাতে ধরে টেনে দাঁড় করায়, তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রীনা, শান্ত হও ক্রীনা। একটু ধৈর্য ধর।
ঠিক তখন তারা মানুষের আর্তনাদ শুনতে পেল এবং হঠাৎ মনে হল বাইরে দিয়ে অমানুষিক শব্দ করতে করতে কিছু একটা ছুটে যাচ্ছে। মানববসতির নানা জায়গা থেকে মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার শোনা যেতে থাকে। আতঙ্কিত লোকজন ছোটাছুটি করতে শুরু করেছে।
রুহান এবং ক্রীনা তাদের ঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না। ছোট ঘরটির মাঝে আটকা পড়ে দুজন এক ধরনের অস্থিরতায় ছটফট করতে থাকে। কতক্ষণ এভাবে কেটে গিয়েছে জানে না। একসময় মনে হল কেউ একজন এসে তাদের ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করছে। খুট করে একটা শব্দ হল এবং দরজা খুলে কালিঝুলি মাখা একজন মানুষ ভিতরে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করে দিল। মানুষটির পিঠে একটি অস্ত্র ঝুলছে, চোখেমুখে ভয়াবহ আতঙ্ক, বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে, মনে হয় সে ছুটতে ছুটতে এখানে এসেছে। ক্রীনা মানুষটিকে চিনতে পারল, সে নিরাপত্তা সেলের একজন সদস্য। ক্রীনা এবং রুহান অবাক হয়ে মানুষটির কাছে এগিয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
মহাবিপদ! মহাবিপদ হয়েছে। মানুষটি এত উত্তেজিত যে সহজে কথা বলতে পারে, তার মুখে কথা জড়িয়ে যেতে থাকে।
কী বিপদ হয়েছে?
মহাজাগতিক প্রাণী বের হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর একটা প্রাণী।
কোথা থেকে বের হয়েছে? ক্রীনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, রুখ কোথায়?
মানুষটি মাথা নিচু করে বলল, আমরা রুখকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিলাম। পারি নি।
পার নি? ক্রীনার বুক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বের হয়ে আসে। পার নি?
না।
কী হয়েছে খুলে বল। তাড়াতাড়ি।
মানুষটি মেঝেতে বসে ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকে। ক্রীনা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে–তার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ তার কাছে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে যায়। কী আশ্চর্য এই সহজ জিনিসটা আগে কেন তার চোখে পড়ে নি!
ক্রীনা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। রুহান অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে ক্রীনা?
আমাকে যেতে হবে?
কোথায়?
রুখকে খুঁজে বের করতে হবে।
রুহান তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ক্রীনার দিকে তাকাল, বলল, তুমি এইমাত্র শুনেছ কিহিতার কী হয়েছে?
হ্যাঁ, শুনেছি।